চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সমঝোতার ভিত্তিতে একক দরপত্র পদ্ধতিতে ঠিকাদার নির্বাচনের অভিযোগ

নিউজগার্ডেন ডেস্ক: সম্পূর্ণ অন্যায় এবং অবৈধ পথে চট্টগ্রাম বন্দরে মোবাইল ক্রেন ক্রয়ের জন্য দীর্ঘদিন ধরে বেসরকারী একটি সংস্থার হাতে জিম্মি হয়ে আছে। প্রতিযোগিতার কোন বালাই নেই। ফি বছর প্রায় ৭০ শতাংশ মোবাইল ক্রেন ক্রয়ের জন্য বিপুল অঙ্কের বাড়তি অর্থ লোপাট করে চলেছে। দরপত্র আহ্বানের ক্ষেত্রে এমন সব শর্ত জুড়ে দেয়া হচ্ছে যেখানে এ বন্দরে আডেন মেরিন লিমিটেড প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কারও পক্ষে অংশ নেয়ার কোন সুযোগ থাকছে না। ফলে এ সংস্থা ইচ্ছেমতো দর দিয়ে বিপুল অঙ্কের অর্থের কাজ হাতিয়ে নেয়ার বিষয়টি ওপেন-সিক্রেটের একটি ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এতে করে দেশে পণ্য আমদানি বাণিজ্যে বাড়তি প্রভাব পড়ছে, যা শেষ পর্যন্ত ভোক্তা পর্যায়ে আঘাত হানছে।

জানা যায়, পরিমাণ ও ওজনে কম-এমন পণ্য লোড করার জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে বহু প্রতিক্ষীত ১০ টনের মোবাইল ক্রেন আবারো আনা হচ্ছে বন্দরে। ২০ টন ৩০ টন ৫০ টনের মোবাইল ক্রেন দিয়ে বন্দরের মালামাল উঠানামা খরচ বেশী পড়ে, তাই চট্টগ্রাম বন্দরে ৯ বছর পর যুক্ত হতে যাচ্ছে অধিক ব্যাবহারী ১০ টন মোবাইল ক্রেন। যন্ত্রপাতির পর্যাপ্ততা নিশ্চিতকরণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে এই ব্যবস্থা। এর আগে ২০১৪ সালে ১০ টন ক্ষমতার দশটি মোবাইল ক্রেন কিনেছিল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। সেবার এ সব ক্রেন সরবরাহের কাজ পেয়েছিল জার্মানির সেনেবুগান কোম্পানি। এবার চবকের প্রায় ৬৯ কোটি টাকার ১০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন ২৩ টি মোবাইল ক্রেন ক্রয়ের দরপত্রে অংশ নিয়েছে ২টি প্রতিষ্ঠান। ‘চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন ইয়ার্ড এবং টার্মিনালের জন্য প্রয়োজনীয় ইক্যুইপমেন্ট সংগ্রহ’ প্রকল্পের আওতায় দশ টন ক্ষমতার ২৩ টি মোবাইল ক্রেন ক্রয়ের জন্য গত ৭-৯-২০ইং ও ২৬-৪-২২ইং, গত ১৬ এপ্রিল পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে চবক। (৩১ মে ২০২৩) ছিল দরপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন।
প্রাপ্ততথ্য মতে, প্রথম ২০২১ দরপত্রে ৫টি, দিৃতীয় ২০২২ দরপত্রে ৪টি, তৃীয়বার দরপত্রে ২ টি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দিয়েছে। খ্যাতনামা মোবাইল ক্রেন প্রস্তুত কারক সেনেবুগেন জার্মানীও “লোকাটেলি ক্রেন ইতালী” স্থানীয় প্রতিনিধি মেসার্স আডেন মেরিন লিমিটেড, প্রথম দরপত্রে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান হলো-ফ্রান্সের মেনিটক ক্রেন গ্রুপ ফ্রেন্স এসএএস, তাদের দেশীয় এজেন্ট হলো ঢাকার এসেনশিয়াল ট্রেড লাইনস লিমিটেড এবং উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ইউএসএ’র মেনিটক; সিঙ্গাপুরের ইকমট্রেড হোল্ডিং (প্রা:) লিমিটেড, তাদের দেশীয় এজেন্ট ঢাকার রিজেন এনার্জি এবং উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান জাপানের কাটু ওয়ার্কস কোম্পানি লিমিটেড; জাপানের তাদানো লিমিটেড, প্রতিষ্ঠানটি নিজেই ক্রেন উৎপাদন করে, তাদের দেশীয় এজেন্ট চট্টগ্রামের কিংস শিপিং অ্যান্ড ট্রেডিং লিমিটেড এবং দরপত্রে অংশগ্রহণকারী চতুর্থ প্রতিষ্ঠানটি হলো জার্মানির সেনেবুগান ফেব্রিকস, এ প্রতিষ্ঠানটিও নিজেরাই ক্রেন তৈরি করে।

মেনিটক ইউএসএ’র যন্ত্রপাতি, ইকমট্রেড এবং সেনেবুগান জার্মানির যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে থাকে। এ পাঁচ টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রথম টেন্ডার ইকম ট্রেড ৫৪,৪৬,৮৮,০০০টাকা মন্ত্রণালয়ের ৫ অক্টোবর ২০২১ অনুমোদনক্রমে দৃিতীয় টেন্ডার আহবান করে ৪টি কোম্পানি অংশ গ্রহণ করে তার মধ্যে শুধুমাত্র ইতালির মোবাইল ক্রেন প্রস্তুত কারক প্রতিষ্ঠান “লোকাটেলি ক্রেনকে বাজেট থেকে ৬ কোটি টাকা বেশি দরে মুল্যায়ন কের ৭৪,৯৮,০০,০০০ টাকায় একক ভাবে কাজটি প্রদান করে চট্টগ্রাম বন্দর।

নিয়মানুসারে ১০% পিজি দিতে দেরি হওয়ায় পিপি আর অনুযায়ী তৃীয়বার টেন্ডার আহ্বান করা হয়। সর্বনিম্ন দরদাতা মোবাইল ক্রেনগুলো সরবরাহের কাজ পাবে। তবে দরপত্র প্রক্রিয়া এ-ই বারও “লোকাটেলি ক্রেনের লোকাল এজেন্সি আডেন মেরিন লিমিটেডকে একক ভাবে বাজেট থেকে বেশী মূল্যে কাজ দেওয়ার অপচেষ্টা চলতেছে। তবে দরপত্র প্রক্রিয়া শেষে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে ওয়ার্ক অর্ডার ইস্যুর প্রায় এক বছর পর ক্রেনগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছাবে।

সূত্র জানায়, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন ইয়ার্ড এবং টার্মিনালের জন্য প্রয়োজনীয় ইক্যুইপমেন্ট সংগ্রহ’ প্রকল্পের মাধ্যমে আটটি গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ মোট ১০৪টি যন্ত্রপাতি কেনা হবে। এর ফলে চট্টগ্রাম বন্দরে কার্গো/ কনটেইনার হ্যান্ডলিং ইক্যুইপমেন্টের পর্যাপ্ততা ৭০ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশে উন্নীত হবে। জাহাজের ওয়েটিং টাইম ৬০ ঘন্টা থেকে ৪৮ ঘন্টায় নেমে আসবে এবং তৈরি পোশাক খাতে পোর্ট লিড টাইম উল্লেখযোগ্য হারে কমবে।
প্রসঙ্গত, দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম বন্দর কার্যক্রমে যুক্ত রয়েছে বেসরকারী ছোট বড় বিভিন্ন সংস্থা। এসব সংস্থার ইতিবাচক কার্যক্রমের ওপর এ বন্দরের সফলতা অনেকাংশে নির্ভরশীল। আবার বেসরকারী কোন সংস্থার একক আধিপত্যের বিস্তৃতি হলে বন্দরের তথা সরকারী অর্থের লোপাট হয়ে যায় বিভিন্ন প্রক্রিয়ায়।

চট্টগ্রাম বন্দরে মোবাইল ক্রেন ক্রয়ের জন্য ২য় টেন্ডার আহবান করা হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চারটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র দাখিল করে। তারমধ্য থেকে একটি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ পাইয়া দেয়। প্রতিষ্ঠানটির নাম লোকাটলি ক্রেন এস আর (ইতালি)। উৎকোচের বিনিময়ে লোকাটলিকে বেশী দামে কার্যাদেশ দিয়ে দেয়। উনসত্তর কোটি টাকার কাজ ৭৫ কোটি টাকার বিনিময়ে দফারফা হয়। টেন্ডার দাতা প্রতিষ্ঠানগুলো সেনেবোগেন ও টরেক্স (জার্মানী), জাপানের তাদানু।
ব্যাংক গ্যারান্টির ১০ পার্সেন্ট জামানত জমা দিতে না পারায় লোকাটলির টেন্ডার বাদ হয়ে যায়।
ঐ ব্যাংক গ্যারান্টি বাজায়েপ্ত করে ৩য় বার টেন্ডার আহবান করা হয়। এতে দুইটি কোম্পানী অংশগ্রহন করে জার্মানীর সেনেবোগান আর ইতালীর লোকাটলি। এবারও আগের মত লোকাটলিকে টেন্ডার পেয়ে দেয়ার জন্য কর্তৃপক্ষ পাঁয়তারা করছে বলে আশংকা প্রকাশ করছে অন্য টেন্ডার দাতারা।

উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বন্দরের ১০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন ১০টি ক্রেন চালু আছে। তারপরও উক্ত কোম্পানীকে কেন বাদ দেয়া হলো বোধগম্য নহে। এ বন্দরে বর্তমানে লোকাটলি ক্রেন এস আর লোকাল এজেন্সি আডেন মেরিন লিমিটেড নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তৃত হওয়ার ফলে অনিয়ম দুর্নীতির ডালপালার বিস্তৃত ঘটে মহীরূহে পরিণত হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে জিম্মিত্ববরণ করেছে এ বন্দর। বন্দরের কোষাগার থেকে বিপুল অঙ্কের বাড়তি অর্থ হাতিয়ে নেয়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে।

বন্দরের বিভিন্ন সূত্রে অভিযোগ করা হয়েছে, লোকাটলি ক্রেন এস আর মোবাইল ক্রেন ক্রয়ের লোকাল এজেন্সি আডেন মেরিন লিমিটেড কাজ বাগিয়ে নিচ্ছে। যেখানে ইচ্ছেমত দর দিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। প্রতিযোগিতামূলক টেন্ডার হলে লোকাটলি ক্রেন এস ুৃৃআর মুল্য এক-দশমাংশে নেমে আসার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

মন্ত্রণালয়সহ উর্ধতন মহলের দুর্নীতিবাজ চক্রের সহায়তায় দিনে দিনে এ সংস্থার একচেটিয়া আধিপত্যের বিস্তৃতি ঘটার ফলে এ বন্দরের সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলো চলছে লোকাটলি ক্রেন এস আর লোকাল এজেন্সি আডেন মেরিন লিমিটেড মর্জিমাফিক। মাঝপথে যারাই ব্যাপক দুর্নীতির বাধা দিতে চেষ্টা করেছেন তাদের পরিণাম হয়েছে হয়রানি ও দুর্ভোগের।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, লোকাটলি ক্রেন এস লোকাল এজেন্সি আডেন মেরিন লিমিটেড একক আধিপত্য চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে বহুক্ষেত্রে হুমকির সৃষ্টিও করেছে। এখানে বেরিয়ে এসেছে বন্দর কার্যক্রমে ক্ষমতার অপব্যবহার, লোকাটলি ক্রেন একক আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে বাড়তি অর্থ লোপাট হওয়ার ঘটনা। শুধু তাই নয়, এ লোকাল এজেন্সি আডেন মেরিন লিমিটেড ঠিকাদারি সংস্থাটির বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগও রয়েছে।

মন্তব্য করুন