নিউজ ডেস্ক

কক্সবাজারে কয়লা ও গ্যাসসহ জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিশ্বব্যাপী নিরাপদ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দাবিতে মানববন্ধন

নিউজগার্ডেন ডেস্ক: বিডাবলুজিইডি (বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপ ফর ইকোলোজি এন্ড ডেভেলপমেন্ট, ক্লীন (কোষ্টাল লাইভলিহুড এন্ড এনভার্মেন্টাল একশন নেটওয়ার্ক) এবং সংশপ্তক এই তিনটি সংগঠনের আয়োজনে আজ কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে এক প্রতিকী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত প্রতিকী বৈঠকে অংশগ্রহন করেন, সংশপ্তক এর উপ পরিচালক অগ্রদূত দাশগুপ্ত, প্রোগ্রাম ফোকাল রফিকুল ইসলাম, সাহিদুল ইসলাম ও হালিমা বেগমসহ স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী।
বক্তারা বলেন, বিগত বছরগুলোর মতো এ বছরও জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন কর্মকাঠামো সনদ (টঘঋঈঈঈ)-এর উদ্যোগে আগামী ৩০ নভেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই শহরে ‘কপ-২৮’ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ সম্মেলনের প্রকৃত নাম ‘জলবায়ু সনদে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রীয় পক্ষসমূহের সম্মেলন’ (ঈড়হভবৎবহপব ড়ভ চধৎঃরবং) বা ‘কপ’ হলেও সাধারণভাবে ‘জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন’ নামে পরিচিত। ১৯৯২ সালের ধরিত্রী সম্মেলনে জাতিসংঘ জলবায়ু সনদ গৃহীত হবার পর ১৯৯৫ সালের মার্চে জার্মানির বার্লিন শহরে প্রথম সম্মেলন (ঈঙচ) অনুষ্ঠিত হয়। দুবাই সম্মেলনটি ২৮তম জলবায়ু সম্মেলন বিধায় একে ‘কপ-২৮’ বলা হয়।
পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান, বৈশ্বিক সংস্থাগুলোর প্রধান, বিজ্ঞানী, জলবায়ু-অধিকারকর্মী, সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাবৃন্দ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য এ সম্মেলনে মিলিত হন। কিন্তু সম্মেলনে কতটুকু কার্যকর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, সে প্রশ্ন রয়েই গেছে। বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থের কারণে শক্ত ও ঋজু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। আবার, আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকায় অধিকাংশ সিদ্ধান্তই যথাসময়ে ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন হয় না। এ কারণেই জলবায়ু-কর্মীগণ দাবি তোলেন, ‘বকবক করো না, কাজ করো’ কিংবা ‘ঐচ্ছিক সমঝোতা নয়, আইনগত চুক্তি চাই’।
জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী অতিরিক্ত গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমনকারী দেশ ও খাতসমূহ। শিল্প বিপ্লবের পর ঔপনিবেশিক দেশগুলো ব্যাপকভাবে যান্ত্রিক উৎপাদনের দিকে ধাবিত হয় যা অতিরিক্ত কার্বন নির্গমনের নতুন ইতিহাস রচনা করে। ২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবী তিন লাখ কোটি টন কার্বন বায়ুম-লে গ্রহণ করতে পারবে। ইতোমধ্যে দুই লাখ ৫০ হাজার টন কার্বন নির্গমন করা হয়ে গেছে। অর্থাৎ পৃথিবীর সহনসীমার ৮৩ শতাংশই ব্যবহৃত হয়ে গেছে এবং মাত্র ১৭ শতাংশ বাকি আছে। যেভাবেই হোক, আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে আর মাত্র ৫০ হাজার কোটি টন কার্বন নির্গমন করা নিরাপদ।
কিন্তু অর্থায়ন ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে ‘ফেয়ার শেয়ার’ নীতি পুরোপুরি অবজ্ঞা করা হয়েছে। অভিযোজন ও প্রশমনে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তা করার জন্য ২০১০ সালে গঠিত সবুজ জলবায়ু জলবায়ু তহবিল (এৎববহ ঈষরসধঃব ঋঁহফ) বা জিসিএফ-এ শিল্পোন্নত দেশগুলো ২০২০ সালের মধ্যে দশ হাজার কোটি ডলার অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিলেও ২০২২ সাল পর্যন্ত মাত্র এক হাজার ৩০ কোটি ডলার দেয়ার ঘোষণা করা হয়েছে এবং ৯৩০ কোটি ডলার দেয়া হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অভিযোজন ও প্রশমনে জিসিএফ থেকে এক হাজার ১৪০ কোটি ডলার প্রদানের চুক্তি করা হয়েছে। কিন্তু এ তহবিলের একটি বড় অংশ চলে গেছে বিশ্বব্যাংক ও এডিবি’র মতো আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে। এছাড়া বেসরকারি খাত থেকে অর্থায়নের কারণে জলবায়ু অভিযোজন ও প্রশমন কার্যক্রম বাণিজ্য ও মুনাফার কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। তাই ব্যক্তিখাত নয়, বরং রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ দিয়েই জিসিএফ-এ অর্থায়ন করতে হবে।
জিসিএফ থেকে অর্থায়নের ক্ষেত্রেও রয়েছে চরম বৈষম্য। জিসিএফ থেকে প্রশমন খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে ৯১ শতাংশ অর্থ। এর বিপরীতে অভিযোজন খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ যা জলবায়ু-বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীর প্রতি চরম অবজ্ঞার নামান্তর। এছাড়া, বাংলাদেশের মতো চরম বিপদাপন্ন দেশে এ পর্যন্ত বরাদ্দ করা হয়েছে মাত্র ৩৭.৪ কোটি ডলার। অথচ, জিসিএফ-এর উদ্দেশ্যই ছিলো বিপদাপন্ন দেশগুলোর জলবায়ু ঝুঁকি কমানোয় অর্থায়ন ব্যবস্থা করা। বর্তমান অর্থায়ন কাঠামো জিসিএফ-এর মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
আমাদের দাবি
১. ২০৩০ সালের মধ্যে শিল্পোন্নত দেশগুলোর কার্বন নির্গমন ২০০৫ সালের তুলনায় কমপক্ষে ৩০ শতাংশ কমাতে হবে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে শূন্য নির্গমন নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে ‘নেট জিরো’ নয়, প্রকৃত’ ‘শূন্য নির্গমন’ চাই।
২. উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশ নির্বিশেষে ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র ও শিল্পখাতে কয়লার ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে কার্বন ধারণ ও সংরক্ষণ (ঈধৎনড়হ ঈধঢ়ঃঁৎব ধহফ ঝঃড়ৎধমব) বা সিসিএস প্রযুক্তি ব্যবহারের দোহাই দেয়া যাবে না।
৩. জীবাশ্ম গ্যাস (এলএনজিসহ) ও পেট্রোলিয়ামে অর্থায়ন ও প্রযুক্তি সরবরাহ অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। রূপান্তরকালীন জ্বালানির নামে এলএনজি’র সম্প্রসারণ বন্ধ করতে হবে।
৪. স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর বিপদাপন্ন জনসাধারণের জলবায়ু অভিযোজনের জন্য সরাসরি অর্থায়ন ও প্রযুক্তি হস্তান্তর করতে হবে।
৫. এলএনডি তহবিলে ঋণ কিংবা বেসরকারি বিনিয়োগ নয়, ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এলএনডি তহবিলে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের অন্তর্ভুক্তি নিষিদ্ধ করতে হবে।
৬. বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দ্রুত ও ন্যায্য জ্বালানি রূপান্তরের জন্য শিল্পোন্নত দেশগুলো থেকে প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে এবং সহজ অর্থায়নের মধ্য দিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলতে হবে।
৭.শিল্পোন্নত দেশগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে জিসিএফ-এ প্রতি বছর ১০ হাজার কোটি ডলার দিতে হবে যাতে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ু-ঝুঁকি মোকাবেলায় পর্যাপ্ত অর্থায়ন নিশ্চিত হয়।
৮. জিসিএফ থেকে চরম বিপদাপন্ন স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের অভিযোজনে অধিকতর গুরুত্বারোপ করতে হবে। এছাড়া এসব দেশে জ্বালানি খাতে ন্যায্য রূপান্তরে অর্থায়ন করতে হবে।
৯. জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাধ্যতামূলক বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীকে ‘জলবায়ু উদ্বাস্ত’ ঘোষণা করে স্বাধীন ও সম্মানজনক অভিবাসনের অধিকার দিতে হবে।
১০. ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ মিথেন হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কৃষিখাতকে এ লক্ষ্যমাত্রার বাইরে রাখতে হবে। এবং
১১. শিল্প, পরিসেবা ও বাণিজ্যসহ সকল খাতে সবুজ রূপান্তরের জন্য স্পষ্ট ও বিস্তারিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।

মন্তব্য করুন