নিউজগার্ডেন ডেস্ক: আরকেএস ফাউন্ডেশন’র উদ্যোগে আজ ২০ জানুয়ারী (শনিবার) বেলা ১১ টায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে এক মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। মানববন্ধনে প্রধান অতিথি তার বক্তব্যে বলেন, দেশে ফসলি জমি কমে আসছে। সেটি হওয়া মানে খাদ্যের উৎপাদনও কমে যাওয়া। আমরা দিন দিন আমদানি নির্ভর দেশ হয়ে উঠছি। দুর্যোগ- মহামারিতে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া আমরা দেখেছি। যে কারণে সরকার থেকে বারবার বলা হচ্ছে, কোনো আবাদি জমি যাতে পতিত না থাকে। এখন সেই ফসলি জমির মাটিই যদি কেটে নেওয়া হয়, তাহলে চাষবাস বা খাদ্য উৎপাদন হবে কী করে। সারাদেশে সেটিই ঘটছে। প্রতিবছর আমন মৌসুম শেষ হওয়ার পরপরই আশঙ্কাজনক হারে কেটে নেয়া হচ্ছে কৃষিজমির টপ সয়েল (জমির উপরিভাগের মাটি)। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, এভাবে ফসলি জমি থেকে মাটি কেটে বিক্রি করার প্রবণতা ভয়ংকর। তা হতে পারে কৃষির জন্য বড় ধরনের হুমকির কারণ। ফসলের উৎপাদনে আসতে পারে বড় ধরনের বিপর্যয়। ক্রমাগত কমতে থাকবে ফসল উৎপাদন। যার ফলে অধিক চাষাবাদেও ফলন হবে কম। দেখা দেবে খাদ্য ঘাটতি। প্রতি বছর শীত মৌসুমে মাটি কাটার এই মহ্যেউৎসব অবাদে চলতে থাকে। শীত মৌসুমে মাঠ থেকে ফসল উঠে যাওয়ার পর পরই এ সময়ে মাটি কাটার জন্য এক্সক্যাভেটর, ট্রাক ও শ্রমিক সরবরাহ করতে থাকে এক শ্রেণির মাটিখেকো সিন্ডিকেট। দেশের আনাচে-কানাচে গড়ে ওঠা বৈধ-অবৈধ ইটভাটার মালিকদের প্রলোভনে পড়ে কিছু জমির মালিক না বুঝে অল্প টাকার লোভে নিজেদের জমির মাটি বিক্রি করে দেয়। অনেক সময় জমির মালিককে না জানিয়ে রাতের আঁধারেই কেটে নেয়া হয় ফসলি জমির (টপ সয়েল) উপরিভাগের মাটি। এই চক্রের সদস্যরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় প্রতিবাদ করার সাহসও পান না জমির মালিকরা। দফায় দফায় প্রতি বছর প্রশাসন কর্তৃক অভিযান পরিচালনা করলেও কিছু অসাধু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে শীত মৌসুমে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে মাটিখেকো চক্রটি।
আবাদি জমির উপরিভাগ কেটে ফেলার ক্ষতি প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদের মতে, প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে মাটি সবচেয়ে মূল্যবান। জমির উপরিভাগের ৬ থেকে ১৮ ইঞ্চির মধ্যেই থাকে সব ধরনের জৈব গুণাগুণ। অথচ এটাই কেটে নেয়া হচ্ছে। ফলে এসব জমির উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। চট্টগ্রামের ১৪ উপজেলায় প্রায় ৪শতাধিক ইটভাটা রয়েছে। মূলত এসব ইটভাটার জন্য প্রয়োজন হয় মাটি। প্রশাসন কর্তৃক ইটভাটার জন্য পুকুর ও অনাবাদি জমির মাটি কাটার অনুমতি রয়েছে। কিন্তু তারা তা না করে ফসলি জমির টপ সয়েল দেদার কাটছে, এতে একদিকে যেমন ধ্বংস হচ্ছে কৃষিজমি এবং জমির কমছে উর্বরতা অন্যদিকে প্রাকৃতিক পরিবেশ চরম হুমকির মুখে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের মতে, কোনো ফসলি জমির টপ সয়েল কাটার অনুমতি কারোর নেই। এরই মধ্যে এ কাজ করার দায়ে অনেককে ভ্রাম্যমাণ আদালতে জরিমানা করা হয় এবং মামলা দায়ের করা হয়। প্রতি বছর এ বিষয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। চলতি বছরও অভিযান অব্যাহত রয়েছে কিন্তু তারপরও বন্ধ করা যাচ্ছেনা অবাদে মাটি কাটা। ফসলি জমির উপরিভাগ কাটা আমাদের পরিবেশের জন্য চরম হুমকি স্বরূপ। এটি দণ্ডনীয় অপরাধ, কিন্তু কে শোনে কার কথা এ কাজে জড়িত প্রভাবশালী রাঘববোয়ালরা। আবার অনেক সময় নতুন নতুন ঘর-বাড়ি তৈরি করার জন্য জমির মাটি কেটে ঘরভিটা উঁচু করে। ফলে মানুষ নিজেরাও কৃষিজমির টপ সয়েল নষ্ট করে। অনেক সময় নতুন করে রাস্তা-ঘাট তৈরি করার জন্য জমির মাটি কেটে রাস্তা বানানো হয়, এতে জমির যেমন গুণাগুণ নষ্ট হয়, তেমনি জমি তার নিজস্ব উর্বরতা হারায়। জমি দিন দিন তার উৎপাদন ক্ষমতা হারায় এবং একসময় অনুর্বর জমিতে পরিণত হয়। এই কারণে কৃষক কঠোর পরিশ্রম করেও তারা বেশি পরিমাণে ফসল উৎপাদন করতে পারেন না এবং ফলে বাড়তে থাকে কৃষকের উৎপাদন খরচ। এভাবে চলতে থাকলে কৃষক ফসল উৎপাদনে অনীহা প্রকাশ করবে এবং এতে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেবে।
চট্টগ্রামের মিরশ্বরাই, ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, সীতাকুন্ড, সন্দ্বীপ, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, পটিয়া, কর্ণফুলী, বোয়ালখালী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, আনোয়ারা, বাঁশখালী অবাধে কৃষি জমির টপ সয়েল (জমির উপরি ভাগের উর্বর অংশ) কেটে নেয়া হচ্ছে ইটভাটায়। ভূমি আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এক শ্রেণির দালাল ফসলি জমির টপ সয়েল কেটে উজাড় করছে। ফলে এলাকার পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি কৃষি উৎপাদন, ফসল, পরিবেশ, জীব বৈচিত্র্য মারাত্মক ঝুঁকিতে। বিভিন্ন এক্সকাভেটর দিয়ে কৃষি জমির উপরিভাগের উর্বর অংশ কেটে ট্রাক-ট্রলি করে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাটি কাটার গভীরতার পরিমাণ ৫ থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে কোথাও কোথাও অর্থনৈতিক ও অনৈতিক আগ্রাসনে পার্শ্ববর্তী মালিকের জমিও নষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে চলাচলে নিষেধ থাকলেও মাটি ভর্তি ভারি ট্রাক, ড্রাম, ট্রাক ও ট্রলি চলাচল করায় গ্রামীণ রাস্তাঘাট ভেঙে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩ অনুযায়ী, কৃষি জমির মাটি কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করলে দুই বছর কারাদণ্ড কিংবা অনধিক পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। এদিকে অজ্ঞাত কারণে এ ব্যাপারে নীরবতা পালন করছে প্রশাসন। অভিযোগ আছে বিভিন্ন সময় স্থানীয় প্রশাসনকে তথ্য প্রদান করলেও খোঁজখবর নেয়া হবে বলেই দায়িত্ব এড়িয়ে গেছে প্রশাসন। প্রশাসনের এই নীরবতা পরোক্ষভাবে জমির টপ সয়েল বিক্রিকে উৎসাহিত করছে বলে অভিযোগ স্থানীয়রাসহ পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর। কৃষি জমির উপরিভাগ কর্তন করা পরিবেশের জন্য হুমকি ও বেআইনি। এই কাজ অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
পরিশেষে, কৃষি ও কৃষক বাঁচাতে বন্ধ করতে হবে কৃষি জমির টপ সয়েল কাটার মহোউৎসব। মাটি কাটার মৌসুমে গ্রামের জনসাধারণকে সচেতন করার জন্য গণমাধ্যম বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে এবং মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডাসহ ধর্মীয় উপসালয়ে বলার অনুরোধ করতে হবে; যাতে কৃষি জমির মালিকরা সচেতন হয়। খাদ্য ঘাটতি পূরণ করার জন্য কৃষিজমির গুরুত্ব অনুধাবন করে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে, বাঁচাতে হবে কৃষক, কৃষি এবং দেশকে। কৃষিবিদ কাজী গোলাম মোস্তফা’র সভাপতিত্বে ও সাংবাদিক ও পরিবেশ আন্দোলন কর্মী মুজিব উল্ল্যাহ্ তুষারের সঞ্চালনায় মানববন্ধনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সিনিয়র সহ সভাপতি ও চ্যানেল আই’র ব্যুরো প্রধান চৌধুরী ফরিদ। আরকেএস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক লায়ন জাহেদুল করিম বাপ্পি সিকদার।