
ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন – যে দেশে গুণীর কদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মায় না! বাঙালিসমাজের ধ্যান-ধারণা ও নানান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় গভীর উপলব্ধি থেকেই নিঃসন্দেহে তিনি এই উক্তি করেছিলেন; যা আজও আমরা জাতিগতভাবে চিন্তাচেতনা ও অস্থিমজ্জায় লালন করে চলেছি! বরং এদেশে জীবিত ব্যক্তির চেয়েও মৃতকেই ঢের বেশি কদর করা হয়; জীবদ্দশায় যাকে অনাদরে, অবহেলায় অবমূল্যায়ন করা হয়, মৃত্যুর পর চরম কপটতা দেখিয়েই তার স্মরণসভা হয়, বছর বছর মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়! তেমনই এক অবমূল্যায়িত কিংবদন্তিতুল্য প্রাণপুরুষ, সমাজহিতৈষী মানবিক চিকিৎসক ডা. শেখ শফিউল আজম – যিনি তার কর্মজীবনের নানামুখী পদচারণা ও স্বীয় উদ্যোগে প্রমাণ করেছেন উদ্দেশ্য যদি মহৎ হয়, লক্ষ্য যদি সঠিক ও স্থির থাকে, প্রচেষ্টা যদি আন্তরিক হয়, তবে স্বল্পোন্নত দেশেও নিম্ন-মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে উন্নত চিকিৎসা সুবিধা পৌঁছানো সম্ভব। তিনি একাধারে একজন সমাজহিতৈষী মানবিক প্রাণ আবার চিকিৎসাদর্শনে একজন মর্মসাধক।
এছাড়াও চট্টগ্রাম রাউজানের কৃতিসন্তান বীরমুক্তিযোদ্ধা ডা. শেখ শফিউল আজমের আছে বহু ত্যাগতিতিক্ষার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ইতিহাস। ছিলেন ছাত্ররাজনীতির সূতিকাগার বাংলাদেশ ছাত্রলীগের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ শাখার সভাপতি এবং ক্রমান্বয়ে চট্টগ্রাম উত্তরজেলা শাখা সভাপতি এবং পরবর্তীতে চট্টগ্রাম উত্তরজেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পঁচাত্তরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সভাপতির দায়িত্বে থাকাকালীন বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে সোচ্চার হলে চট্টগ্রামে ঘাতক সহচরদের দ্বারা তিনিও নির্মমভাবে নির্যাতিত ও ছুরিকাহত হন; তার নিথর দেহ ফেলে দেয়া হয় চট্টেশ্বরীর নালায়! পত্রপত্রিকায় তার নিহত হওয়ার সংবাদও ছাপা হয় সেসময়। পরম করুণাময়ের কৃপায় অসীম সাহসী তরুণ শফিউল আজম সেযাত্রায় বেঁচে যান, যদিও তার ন্যাজাল স্যাপ্টাম (অনুনাসিক হাঁড়)সহ দেহের বিভিন্ন অংশের হাঁড় ভেঙ্গে যায় যা এখনো ক্ষণেক্ষণে ব্যাথায় কাতর করে তাঁকে;
তবুও থেমে থাকেনি তার রাজনৈতিক ও সামাজিক কার্যক্রম! বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির বোর্ড মেম্বার ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন।
বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সাধারণ একটি ইউনিট চট্টগ্রাম জেলা – যা পরবর্তীতে ডাঃ শেখ শফিউল আজমের হাত ধরে দেশ ও বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন ও সেবার মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট পরিচালিত চট্টগ্রামস্থ জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট মাতৃসদন হাসপাতালের পরিচালনা পরিষদের নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর হাসপাতালের পূর্বপাশের পাঁচতলা ভবন পুন:সংস্কার করে ৩৮টি অনুন্নত কেবিন থেকে ১০৫টি উন্নত কেবিনে রূপান্তর করেন তিনি। সেসময় হাসপাতালের লেবার রুমের পাশে ছিলো অপারেশন থিয়েটার যা চরম অব্যবস্থাপনা ও রোগীদের জন্য অসহনীয় বিড়ম্বনায় জর্জরিত ছিলো; এই সমস্যা নিরসনে ডা. শফিউল আজম নিজ তাগিদে পূর্বপাশের খালি অবকাঠামোতে নতুন কেবিন স্থাপন করার উদ্যোগ নেন। নিজের সৃজনশীল চিন্তাকে কাজে লাগিয়ে একটি উন্নত অপারেশন থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে একসাথে দুজন রোগীর সিজার সম্পন্ন করা সম্ভব। এছাড়াও মেটারনিটিতে অপরিপক্ক ও জন্ডিস আক্রান্ত নবজাতক শিশুর জন্য ফটোথ্যারাপির ডিভাইসের প্রয়োজন অনুভব করে তিনি তা দ্রুত স্থাপনের উদ্যোগ নেন। মেটারনিটি হাসপাতালে একটি এনআইসিউ’র প্রয়োজনীয়তা অত্যধিক, তাঁর আবদারে ২০২২ সালে এম মাহবুব চৌধুরী নামক জৈনক স্বহৃদয়বান ব্যক্তি ও সমাজসেবক এই এনআইসিউ প্রতিষ্ঠা করার ব্যবস্থা করেন এবং সম্প্রতি তা উদ্বোধন করা হয়। তৎকালীন জেমিসন রেডক্রিসেন্ট হাসপাতালের অধীনস্থ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে শুধুমাত্র রক্তগ্রুপ নির্ণয়; প্রস্রাব ও রক্তের সাধারণ রুটিন পরীক্ষা হতো, যা পরবর্তীতে শফিউল আজম স্বউদ্যোগে অত্যাধুনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার & মাল্টিসেক্টরাল ডায়াগনস্টিক কমপ্লেক্সে রূপান্তর করেন, এছাড়াও স্থাপন করেন উন্নত মানের থ্রিডি (কালারডপলার) আল্ট্রাসোনোগ্রাম মেশিন। জোট সরকারের আমল থেকে একাধিক চেষ্টা-তদবিরের পরেও প্রতিষ্ঠায় বারবার ব্যর্থ হওয়া ‘জুনিয়র মিডওয়াইফারী ইনস্টিটিউট’টি পরবর্তীতে ডা. শেখ শফিউল আজমই তার প্রজ্ঞা ও দক্ষতায় প্রতিষ্ঠা করেন এবং তা বাংলাদেশ সরকারের নার্সিং কাউন্সিলের অধীনে অনুমোদিত করেন।
হাসপাতালের কার্যক্রম পরিচালনাকালে তিনি একটি নার্সিং ইনস্টিটিউটের প্রয়োজন অনুভব করলে উনার একক প্রচেষ্টা ও উদ্যোগে গড়ে তুলেন একটি সকল সুবিধাসম্বলিত উন্নত নার্সিং ইন্সটিটিউট। এভাবে তিনি উক্ত প্রতিষ্ঠানকে শুধু চিকিৎসাক্ষেত্র নয় শিক্ষালয় এবং কর্মসংসস্থানের ক্ষেত্র হিসেবেও পরিণত করেন। বর্তমানে উক্ত নার্সিং ইন্সটিটিউট থেকে পাশ করে প্রতিবছর শত শত স্বাস্থ্যসেবিকা মানবতার সেবায় নিয়োজিত হচ্ছে। নার্সিং ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠার পর ছাত্রীদের থাকা খাওয়ার সুবিধার জন্য ডাঃ শেখ শফিউল আজম আবাসন ব্যবস্থার উদ্যোগ নেন। তখন স্বল্প অবকাঠামোতে একটি রুমে ১০ জন ছাত্রী থাকার ব্যবস্থা ছিল। এ বিষয়ে আইএফআরসি প্রধানকে বারংবার অনুরোধ করে আবাসন ব্যবস্থার জন্য অনুদান অনুমোদনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেও তিনি থেমে থাকেননি। ব্যক্তিউদ্যোগ ও তদবীরে মামাসম্বন্ধীয় দানবীর এস এম ইউছুপের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রায় ৬০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে তিনি ছাত্রীদের জন্য গড়ে তুলেন পাঁচতলা বিশিষ্ট একটি নার্সিং ভবন। সেইসাথে ছাত্রীদের আবাসন ব্যবস্থা, অধ্যক্ষের জন্য একটি রুম, পঞ্চাশ জন শিক্ষার্থী ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ২টি ক্লাসরুম, ২টি ডিসেকশন রুম, ১টি লাইব্রেরী, ২টি শিক্ষক কমনরুম; নামাজের জন্য একটি ইবাদাতখানা, একটি গোডাউনসহ অসংখ্য অবকাঠামো নির্মাণ করেন তিনি ধাপেধাপে।
এছাড়াও তাঁর প্রচেষ্টায় নার্সিং-এর শিক্ষার্থীদের আরও দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও জেনারেল হাসপাতালে ইন্টার্নশিপের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অধীনে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। ফলশ্রুতিতে পাশ করার পর তারা প্রশিক্ষিত হয়ে দেশ-বিদেশে সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যপ্রতিষ্ঠানের চাকরিতে নিয়োগ প্রাপ্ত হচ্ছে এবং সুনামের সাথে কাজ করে যাচ্ছে। নার্সিং খাতকে আরও শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ করতে রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান এটিএম আব্দুল ওয়াহাবের আন্তরিক পরামর্শ ও দিকনির্দেশনায় একটি নার্সিং কলেজের প্রজেক্ট অনুমোদনের জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাঃ শেখ শফিউল আজমের মাধ্যমে আবেদন করা হয়েছে যা অধিদপ্তরকর্তৃক পরিদর্শন সমাপ্ত হয়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দিয়েছেন। অতিশীঘ্রই অবকাঠামো, শ্রেণীকক্ষ ও আনুষাঙ্গিক সব ঘুচিয়ে গেলে সচিবালয় ও নার্সিং কাউন্সিল যথাযথ পরিদর্শন ও নিরীক্ষণ সাপেক্ষে অনুমোদন প্রদান করবেন।
হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্যেও সকল সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করেন ডা: শফিউল আজম। ইউনিট অফিসে একজন ইউএলও ও একজন সহকারি বসার ব্যবস্থাও ছিলো না, সেই অফিসে ফাইলপত্রগুলো উইপোকায় খেয়ে তছনছ করে ফেলছিল, প্রয়োজনমতো সেই রুমটিকেও সংস্কার করেন তিনি। উল্লেখ্য যে, রোগীদের সুবিধার্থে হাসপাতালে তাঁর উদ্যোগেই ভালো ও উন্নত মানের লিফট স্থাপিত হয়।
হাসপাতালের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার জন্য পুরো হাসপাতাল এলাকাকে সিসিটিভির আওতায় আনা হয়েছে এবং অনাকাঙ্খিত অগ্নিসংযোগ ও বিস্ফোরণ থেকে বাঁচার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ফায়ার ডিস্টিংগুইশার লাগানো হয়েছে এবং সেগুলো বছর বছর হালনাগাদও করা হয়। হাসপাতালে দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছর ওয়াসার পানির ব্যবস্থা ছিলো না। ডাঃ শফিউল আজম ওয়াসা ম্যানেজিং বোর্ডের সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার পর ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে মূল লাইন থেকে ওয়াসার পানির ব্যবস্থা করে দেন। হাসপাতালের অবকাঠামোতে একটি ইলেকট্রিক ট্রান্সফরমার প্রয়োজন ছিল যা ২০২১ সালে ডাঃ শেখ শফিউল আজম স্থাপনের ব্যবস্থা করেন। এভাবেই হাসপাতালের রোগী, কর্মচারী, কর্মকর্তা সকলের ছোটখাটো সকল সুবিধা অসুবিধা বিবেচনা করে অবিরত কাজ করেছেন তিনি। সব পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানকে সুষমভাবে পরিচালিত করে গিয়েছেন ডা. শেখ শফিউল আজম।
উক্ত প্রতিষ্ঠান নিয়ে ডাঃ শেখ শফিউল আজমের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ছিলো সুদূরপ্রসারী। তাই ২০১২ সালে একটি সিন্ডিকেট সভায় উক্ত হাসপাতালকে জেনারেল হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ করার জন্য তিনি প্রস্তাব পেশ করলে, তহবিল সংগ্রহকারী কার্যক্রমের মাধ্যমে একটি ১৫ তলা ভবনের অবকাঠামো তথা রেড ক্রিসেন্ট জেনারেল হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ নির্মাণের সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে উক্ত সভায় গৃহিত হয়। সিন্ডিকেট সভায় উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন; বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও তৎকালীন বন ও পরিবেশ মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ. এমপি; মহানগর আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক আ.জ.ম নাছির উদ্দিন, সাইফুজ্জামান জাভেদ এমপি সহ প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ। যদিও পরবর্তীতে সিডিএ কর্তৃক ১৩ তলা শর্তসাপেক্ষে ভবনটির অনুমোদন প্রদান করা হয়। তবে উল্লেখ্য যে, সিডিএ অনুমোদন কার্যক্রম মাঠতদন্তে দেখা যায় ভবনের জন্য নির্ধারিত স্থানটি সরকারি খাসভুক্ত জমির অন্তর্ভুক্ত, যেখানে কোন প্রাতিষ্ঠানিক ভবন নির্মাণ করা দুরূহই নয়, অসম্ভব। এক্ষেত্রেও সবচেয়ে বড় ভূমিকাটা রাখেন ডা: শফিউল আজম; ২০১৩ সালে খতিয়ান পরিবর্তন ও রেড ক্রিসেন্টের নিজস্ব জায়গায় পরিণত করে খতিয়ানভুক্ত করার জন্য জেমিসন হাসপাতাল চট্টগ্রাম জেলা রেড ক্রিসেন্ট ইউনিটের পক্ষে শফিউল আজম একটি মামলা (৩৫৮/১৩) করেন যা তিনি ব্যক্তিগত প্রায় বারো লক্ষ টাকা খরচ করে মামলাটি একযুগ ধরে চলমান রাখেন। যার ফলস্বরুপ চট্টগ্রাম জেলা রেড ক্রিসেন্ট আজ নিজস্ব জমির দাবিদার হতে পেরেছে। বর্তমানে নামজারীর জন্য সংশোধিত কপি এ/সি ল্যান্ড – এ জমা হয়েছে এবং অতি শীঘ্রই নামজারীর কাজটিও সমাধান হয়ে যাবে। শুধুমাত্র জেলা ইউনিটের জন্য নয় কেন্দ্রীয় রেড ক্রিসেন্ট তথা জাতীয় পর্যায়েও ডা: শফিউল আজম অনন্য ভূমিকা রাখেন।
তৎকালীন বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পতেঙ্গাবেইজড ডিপোতে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির জন্য বরাদ্দকৃত ৫.২ একর জায়গা ছিল। পরবর্তীতে বন্দর কর্তৃপক্ষ অধিক জাহাজ নোঙ্গর করতে টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা নিলে তারা রেডক্রিসেন্টর উক্ত জায়গা ফেরত নিয়ে বে-টার্মিনালে ঐ পরিমাণ জায়গা দিতে চায়। কিন্তু বোর্ড মেম্বার ডাঃ শেখ শফিউল আজম নাছোড়বান্দা হয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে ৫.২ একর জায়গার পরিবর্তে ৭ একর জায়গা আদায় করেন। বর্তমানে চর রাঙ্গাদিয়াতে বন্দর কর্তৃপক্ষ তিন একর জায়গা প্রদান করেছেন যেখানে বন্দর কর্তৃপক্ষ একটি গোডাউন, একটি শেড ও একটি ডরমেটরি তৈরি করে দিয়েছেন যা বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির পক্ষে স্থানান্তর ও চুক্তিপত্রে বিডিআরসিএস এর পক্ষ থেকে ক্ষমতা অর্পণ করায় বোর্ড মেম্বার হিসেবে ডাঃ শেখ শফিউল আজম স্বাক্ষর প্রদান করেন। সম্প্রতি উক্ত জায়গা একটি বেসরকারি পাওয়ার প্লান্ট প্রতিষ্ঠানের সাথে মাসিক ১৫ লক্ষ টাকা ভাড়া প্রাপ্তিশর্তে চুক্তিবদ্ধ হয় যা রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির তহবিলে জমা হচ্ছে। এছাড়াও কালুরঘাটে মেরিন ইউনিভার্সিটি স্থাপনের জন্য জায়গা ভরাট শেষ হলে সেখান থেকে বাকি চার একর জায়গা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিকে হস্তান্তর করা হবে। এসব জায়গা থেকে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি বহুলাংশে লাভবান হচ্ছে ও হবে, যা বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির জন্য সোনার হরিণ পাওয়া স্বরূপ! একটি সংস্থা ও স্বাস্থ্যখাতের জন্য এতোটা কর্মপরিকল্পনা ও অবদান রাখার মতো ত্যাগী ব্যক্তিত্ব দুর্লভ বটে। এরপরও হাসপাতাল বা ইউনিটের উন্নয়নের জন্য কোন আর্থিক অনুদান না পেলেও ডাঃ শেখ শফিউল আজম নিজ অর্থায়নে ও নিজ প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন সাধন করেছেন। হাসপাতালের যেকোন ছোটখাটো যন্ত্রপাতি ক্রয় ও মেরামতের বিষয়েও ডাঃ শেখ শফিউল আজম সর্বদা সচেতন থাকতেন। ব্যক্তিগত তহবিল থেকে প্রায় দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা সিজারের যন্ত্রপাতি কেনার অনুদান হিসেবে প্রদান করেন তিনি। ২০১৩ সালে ডাঃ শেখ শফিউল আজম কর্তৃক একটি ডায়টার্মি কয়টারি মেশিন প্রদান করা হয়। ৯০টি ফ্যান ও ২০০টি প্লাস্টিক চেয়ার ২-৩ ধাপে বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ থেকে অনুদান হিসেবে নেওয়া হয়। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি থেকে ফাতেমা বেগম ব্লাড ব্যাংকের জন্য ১টি বাস বরাদ্দ নেন তিনি।
তবে নানানসময়ে সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে সরকারের বিভিন্ন উচ্চমহলের সুপারিশে প্রতিষ্ঠানে লোকবল বেড়ে যায়, ফলস্রুতিতে জেমিসন মাতৃসদন হাসপাতালের নরমাল ও সিজার ডেলিভারির ফি দিয়ে কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বেতন ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এতোটাকাল সাধারণ মানুষ স্বল্পখরচে সেবা পাওয়ার আশায় এই মেটারনিটিতে আসতো যা পর্যায়ক্রমে বিগত এক দুবছরে হঠাৎ করেই অনেকটাই বেড়ে সাধারণ বেসরকারি হাসপাতালের সমতুল্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, ক্ষেত্রবিশেষে আরও বেশি খরচ নেওয়া হচ্ছে! একটা দাতব্যপ্রতিষ্ঠান হঠাৎ করে এমনভাবে বাণিজ্যিকরূপ নিবে তা মানা যায় না! দেশের আর্থিক পরিস্থিতি ও সাধারণ মানুষের উপার্জনক্ষমতা বিবেচনায় এই দাতব্যচিকিৎসালয়ের সেবামূল্য নিয়ন্ত্রিত ও নাগালের মধ্যে থাকা উচিত বলে মনে করে জনসাধারণ।
বলা বাহুল্য, চট্টগ্রাম জেলা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রত্যেক কোণায় কোণায় ডাঃ শেখ শফিউল আজমের অবদান অনস্বীকার্য! এনআইসিউ, নার্সিং ইন্সটিটিউট, মিডওয়াইফারি ইন্সটিটিউট, থ্যালাসেমিয়া সেন্টার প্রতিষ্ঠাসহ জেমিসন রেডক্রিসেন্ট হাসপাতালের অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধন করেছেন তিনি। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, চট্টগ্রাম জেলার মতো ছোট একটি ইউনিটে কিভাবে এতকিছু করা সম্ভব হচ্ছে সে বিষয়ে ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে ২০১০ সাল থেকে অনেকে দূর্নীতি দমন কমিশনে মামলা/অভিযোগ করেছে। মজার বিষয়, সকল মামলা/অভিযোগ নিষ্পত্তি করে জেমিসন হাসপাতালে মামলা নথিভুক্ত হয়েছে।তদন্তে নূন্যতম কোন দূর্নীতির প্রমাণও পাওয়া যায়নি, বরঞ্চ দুদক কোন দূর্নীতির প্রমাণ না পেয়ে জেলা রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির ভূয়সী প্রশংসা করেছে।
এছাড়াও বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি কেন্দ্রীয় বোর্ড কর্তৃক নিয়োগকৃত অডিটফার্মের মাধ্যমে প্রত্যেক বছর জেমিসন রেডক্রিসেন্ট হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা ও আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছনা নিরুপণে অভ্যন্তরীণ ও বহি:নিরীক্ষণ যথাযথভাবে সম্পন্ন হয়; এমনকি সামান্যতম ত্রুটি-বিচ্যুতির ক্ষেত্রেও বিডিআরসিএস কর্তৃক উর্ধ্বতন কমিটির মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন পাশ করা হয় – যা এ প্রতিষ্ঠানকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতায় অনন্য করে রেখেছে।
করোনাকালে মানবতারকল্যাণে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন ডাঃ শেখ শফিউল আজম। করোনা মহামারীর সময় উত্তম সেবাদানের লক্ষ্যে হাসপাতালে জরুরীভিত্তিতে কোভিড ডেডিকেটেড দশ বেডের আইসোলেশন সেন্টার স্থাপন করেন। নিজের সর্বাত্মক দিয়ে জীবনের পরোয়া না করে সশরীরে তিনি করোনা রোগীদের বিনামূল্যে সেবা প্রদান করেছেন এবং যথাসাধ্য হাসপাতালে পর্যাপ্ত পরিমাণ করোনা মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা করেছেন। এছাড়াও বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত চট্টগ্রাম বিভাগীয় করোনা প্রতিরোধ সেলের অন্যতম কার্য নির্বাহী সদস্য হিসেবে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের সাহচর্যে সর্বাত্মক ভূমিকা রাখেন। বাংলাদেশ প্রশাসনের সহায়তায় যুব স্বেচ্ছাসেবকরা ডাঃ শেখ শফিউল আজমের নেতৃত্বে কোভিডকালীন চিকিৎসাসেবায় অভূতপূর্ব ভূমিকা রাখেন। এতেই তিনি থেমে থাকেননি, চট্টগ্রামের স্পটে স্পটে রান্না করা ও শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করেছেন, মানবিক তাড়ণায় অসহায় মানুষের জন্য ত্রাণ এবং দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে অনুদান জোগাড় করেছেন ও বন্টন করেছেন। এমনকি চট্টগ্রাম মেডিকেলে জরুরীভিত্তিতে কোভিড আইসোলেশন ওয়ার্ড ও ল্যাব প্রতিষ্ঠায়ও তিনি ভূমিকা রাখেন। এছাড়াও করোনাকালে রেড ক্রিসেন্টের উদ্যোগে মুরাদপুরে একটি কোভিড ডেডিকেটেড করোনা সেন্টার ও ফ্লু আইসোলেশন সেন্টার স্থাপন করেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন পয়েন্টে তাঁর দ্যোগে কোভিড-১৯ সনাক্তকরণের সবেচেয়ে নির্ভরযোগ্য পরীক্ষাপদ্ধতি আরটি পিসিআর এর মাধ্যমে করোনা শনাক্তকরণের নিমিত্তে স্যাম্পল কালেকশন বুথ স্থাপন করা হয়। করোনাকালীন চট্টগ্রামে ফ্রন্টলাইনার হিসেবে ভূমিকা রাখা প্রতিটি স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকদের সর্বদা প্রেরণা দিয়ে খোঁজখবর নিতেন ও প্রয়োজনীয় সবকিছুর ব্যবস্থা করতে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট ছিলেন শফিউল আজম। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ও নিজ পরিবারের স্ত্রীসন্তানসহ সকল স্বাস্থ্যকর্মী সদস্যদের নিয়ে দৈনিক শত শত রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা ও ঔষধপত্র দিয়েছেন। আর তাই কোভিডকালীন সময়ে তাঁর বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন তাকে সম্মাননা দিয়ে প্রশংসিত করেছেন। উল্লেখ্য যে, ২০১০-১১ সনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সদস্য সচিবের দায়িত্ব থাকাকালীন চট্টগ্রাম বিভাগের প্রায় প্রতিটি উপজেলায় বিনামূল্যে চিকিৎসা ক্যাম্পের মাধ্যমে শতো রোগীকে চিকিৎসাসেবা ও ঔষধপথ্য প্রদান করেন। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, আজকের প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন ডা: শেখ শফিউল আজম। চট্টগ্রাম নগরের সাবেক সফল মেয়র চট্টলরত্ন প্রয়াত এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে ও সার্বিক সহযোগীতায় বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে ডা: শফিউল আজমের সর্বাত্মক প্রচেষ্টার ফসল চট্টগ্রামবাসীর অনন্য এক অর্জন আজকের নগরীর ফৌজদারহাটস্থ চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। তাঁর মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার এই দীর্ঘ সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাঁথার গল্প অন্য কোনদিন বিস্তারিত তুলে ধরার চেষ্টা থাকবে।
সার্বিকবিবেচনায় বলাই যায়, ডা: শেখ শফিউল আজম একজন সফল চিকিৎসাবিদ, সফল হাসপাতাল প্রশাসক, মানবতার আলোকবর্তিকাবাহী একজন সফল সমাজ সংগঠক। যুগেযুগে মহান মানবতা ও সমাজহিতৈষী মহতী প্রাণগণ অভিষ্ট্য লক্ষ্যে ছুটতে গিয়ে চলার পথে ক্ষণেক্ষণে পরশ্রীকাতর ও প্রতিক্রিয়াশীলদের দ্বারা বাঁধাগ্রস্ত হয়ে এসেছেন; তাঁদের পথ রুদ্ধ করার শতো প্রচেষ্টা করা হয়েছে – তবুও দিনশেষে তাঁরা মানুষের ভালোবাসা ও দোয়ায় শেষ হাসিটা সফলতার সাথেই হাসেন – তেমনই এক ব্যক্তিত্ব ডা: শেখ শফিউল আজম।
তাঁকে সমাজসেবায় ‘একুশে পদক’ – এ ভূষিত কিংবা রাষ্ট্রীয়সম্মানে যথাযথ মূল্যায়িত করাটা প্রাণের দাবী হয়ে রইলো।মানবতার সেবায় নিবেদিত এই মহাত্মাগণ আমাদের প্রেরণার উৎস হয়ে বেঁচে থাকুক যুগ যুগ, জীবদ্দশায় পাক যথাযথ মূল্যায়ন, সম্মান এবং সুমহান মর্যাদা।
লেখক: এস. এম. ইকরাম হোসাইন
ল্যাব কনসালটেন্ট ও বায়োমেডিকেল গবেষক
সংগঠক, মানবাধিকার ও সমাজকর্মী