
বীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ফজল আহমদ: ১৭ মার্চ, বাঙালি জাতির জন্য এক ঐতিহাসিক দিন। শেখ লুৎফর রহমান ও সাহারা খাতুনের ঘর আলোকিত করে এই বাংলার মাটিতে জন্ম নিয়েছিল টুঙ্গিপাড়ার ‘খোকা’। সে ‘খোকা’ই একদিন হলো বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় শিশু দিবসটি মূলত বঙ্গবন্ধুর শিশুকালকে স্মরণের উদ্দেশ্যে পালন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শিশুদের অত্যন্ত ¯েœহ করতেন, তিনি বিশ্বাস করতেন শিশুরাই সোনার বাংলা রূপান্তরের ভবিষ্যত কর্ণধার। তারাই একদিন বিশ্বের নেতৃত্ব দেবে। একটি শিশুর স্বপ্নকে সফল করতে পারে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র। অথচ, আজ সমস্ত জায়গায় শিশুরা অবহেলিত ও নির্যাতিত। এখনকার শিশু-কিশোরদের মাঝে নৈতিক গুণাবলীগুলো খুব একটা খুঁজে পাওয়া যায় না। শিশুদের কোমলতার সুযোগ নিয়ে তাদেরকে দিয়ে অনেক অনৈতিক কাজের সাথে জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, এতে করে কিছু সুবিধাবাদী স্বার্থন্মেষী মানুষের ছত্রছাঁয়ায় জন্ম নিচ্ছে ‘‘কিশোর গ্যাং’’। এতে করে সমাজের অসঙ্গতিগুলো বিরুদ্ধে যে শিশুরা একদিন বড় হয়ে প্রতিবাদ করার কথা তারাই অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ভাষাটুকু হারিয়ে ফেলছে। আজকের শিশু-কিশোররা মানবতার শিক্ষা না পাওয়ার কারণে আত্মকেন্দ্রিক হওয়া শিখছে। তারা কিভাবে সম্মেলিতভাবে সমাজকে সুন্দর করে সাজাতে হয়, বৈষম্যহীন সমাজ গঠন করতে হয় সে বিষয়গুলো শিখছে না। এগুলোর পিছনেও কিন্তু অনেক কারণও রয়েছে। একটা সময় ছিল শিশুকালে গ্রাম বা শহরে পর্যাপ্ত পরিমাণে খেলাধুলা করার ও বিনোদনের জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধা ছিল। কিন্তু শিশুদের উন্মক্ত মনে বেড়ে ওঠার জন্য বিকল্প খেলাধুলার মাঠ, পার্ক, বিনোদন কেন্দ্র তৈরি না করে খালি জায়গা, মাঠগুলোতে বিভিন্ন বাণিজ্যিক, শিল্প কারখানা, প্রাতিষ্ঠানিক, এপার্টমেন্ট নির্মাণের ফলে বর্তমানে শিশুদের এই সুযোগ সীমিত হয়ে এসেছে। ইট-পাথরের খাঁচায় বন্ধী হয়ে যাচ্ছে শিশুরা। এই বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেতে শিশুরা বেছে নিচ্ছে মোবাইল, ট্যাব, লেপটপ। যে সময়টা তারা মাঠে খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা, সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে তাদের দেখা যায় ভার্চুয়াল জগতে। মন-মস্তিষ্ক, খেলাধুলাও সেখানেই। অভিভাবকরাও এত ব্যস্ত যে শিশুদের সময়ই দেন না। কর্মজীবী মা-বাবা শিশু দেখাশোনার ভার ছেড়ে দিয়েছে গৃহকর্মী ওপর। তখনকার দিনের মানুষেরা যেভাবে মা-বাবার আদর, ¯েœহ, মমতা, শাসন পেয়েছিল, সেখানে এখন মা-বাবার সময়ের ব্যস্ততার কাছে শিশুরা হয়ে পড়ছে একাকি নিঃসঙ্গ। অনেক শিশুরা এখনো খুব অবহেলিত একটা পরিবেশে বড় হচ্ছে। শিক্ষার হার তুলনামূলক বাড়লেও এখনো অনেক শিশুই তাদের প্রকৃত অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আছে শিশু শ্রমের মতো প্রকট কিছু সমস্যাও। শিশুর ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করতে তাদের মাদকের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে বুঝাতে হবে। শিশুদের সাইবার দুনিয়ায় অবাধ প্রবেশ ঠেকাতে তাদের বড় হওয়ার সাথে সাথে লেখাপড়ার পাশাপাশি সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া জগতের সাথে সম্পৃক্ত করতে উদ্যোগী হতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শিশুদের গুরুত্ব অনুধাবন করে স্বাধীনতা পরবর্তী প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক করেছিলেন। ১৯৭৩ সালে প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করে ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারি করেন তিনি। স্বল্প সময়ের মধ্যে ১১ হাজারের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের কাজও করেছিলেন। তিনি লেখাপড়ার পাশাপাশি শিল্প-চর্চার মধ্য দিয়ে শিশুর বিকাশ ঘটাতে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন এ দেশের শিশুরা শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে বাঁচুক। পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে তারা শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা করতে করতে বড় হোক। উনি এতটাই সংস্কৃতিমনা ছিলেন যে, উনি চাইতেন শিশুরা হাসবে, গাইবে, ছবি আঁকবে, গল্প লিখবে। কারণ, সংস্কৃতি চর্চা না করলে সত্যিকার অর্থে ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে উঠতে পারবে না।
আমাদের দেশেও শিশুরা বছর জুড়েই নানাভাবে নির্যাতন, ধর্ষণ ও নির্মমতার শিকার হয়েছে। অথচ শিশুদের জন্য একটি সুস্থ সমাজ গড়তে না পারলে স্মার্ট রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলা যাবে না। শিশুর প্রতি নির্দয়তা নয়, হিংসা নয়, তাদের বড় করতে হবে মানবিক আচরণে।
শিশুর প্রতিপালনে বাবা-মায়ের সচেতনতা খুবই জরুরী। শিশু ঠিকমতো বেড়ে উঠছে কি-না সে ব্যাপারে সার্বক্ষণিক দৃষ্টি দিতে হবে। সন্তান চোখের আড়াল হ’লে খোঁজ খবর রাখতে হবে যে, জীবন বিধ্বংসী কোন কাজে জড়িয়ে পড়ছে কি-না কিংবা তার ভবিষ্যৎ বিনষ্টকারী কোন আড্ডায় সে গেল কি-না। বাবা মায়ের অসতর্কতা ও অসচেতনতার কারণে সন্তান বিপথগামী হয়ে পড়ে। আর সন্তানের বিপথগামিতা যে কেবল সংশ্লিষ্ট পরিবারটির জন্যই ক্ষতিকর তা নয়; বরং গোটা সমাজ তথা রাষ্ট্রের জন্যই ক্ষতিকর। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, গভীর ভালোবাসায় শিশুবান্ধব পরিবেশে আগামী প্রজন্মকে সুশিক্ষিত করতে পারলেই গড়া যাবে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিশুর জন্য যে অবদান রেখেছিলেন, সে আদর্শকে ধারণ করে এগিয়ে যেতে পারলে আগামীর ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ এ আদর্শ এক সমাজ গঠনের কাজ অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধু সব শিশুর অধিকার নিশ্চিতে আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। এজন্য স্বাধীনতা পরবর্তী তিনি দেশে যেসব যুদ্ধশিশু জন্ম নিয়েছিল তাদেরসহ বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনে বঙ্গবন্ধু গঠন করেন বাংলাদেশ পুনর্বাসন বোর্ড। ঢাকার ধানমন্ডিতে যে পুনর্বাসন কেন্দ্রটি ছিল তা পরিচালনা করতেন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তা বাংলাদেশের প্রতিটি শিশুর জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চকে ‘জাতীয় শিশু দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে শিশু দিবস হিসেবে পালন করার মাঝের একটা সৌন্দর্য আছে, বঙ্গবন্ধুর মতো আমরাও যদি শিশুদেরকে সমান গুরুত্ব দিই, তাদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হই, তবে বাংলাদেশ এক সোনালী ভবিষ্যত প্রজন্ম পাবে, এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: প্রবন্ধকার ও মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কমান্ডার, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, প্রাতিষ্ঠানিক কমান্ড, চট্টগ্রাম। সাবেক যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।