নিউজ ডেস্ক

১৭ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমার সিনিয়র এডভোকেট আবু মোহাম্মদ য়্যাহ্য়্যা স্মরণে

এডভোকেট মোহাম্মদ আলী: সিনিয়র এডভোকেট আলহাজ্ব আবু মোহাম্মদ য়্যাহ্য়্যা সম্পর্কে আলোচনা করার মত বিশদ কোন জ্ঞান আমার নেই। তবে এতটুকু জানি, তিনি একজন মহান ব্যক্তি ছিলেন, যিনি আমাকে হাতে কলমে ওকালতি পেশা শিখিয়েছেন । তিনি আমাকে ছোট ভাইয়ের মত স্নেহ করতেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়।

আমি মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডার ছিলাম। আমি গ্রুপ নিয়ে প্রায় সময় গুমানমর্দন, নাঙ্গলমোড়া ও ছিপাতলী ইউনিয়নে থাকতাম। সেখান থেকে বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন চালিয়ে ফিরে আসতাম। ফটিকছড়ি এলাকায় একটি অপারেশন করব এ কারণে একজন সেল্টারদাতার মাধ্যমে গুমানমর্দন এলাকায় হালদা নদীর তীরে একটি বাড়ীতে অবস্থান নিলাম। তখন সিনিয়রের সাথে আমার পরিচয় ছিল না এবং এটা যে তাঁর বাড়ী তাও জানতাম না। যে রাত্রে ঐ বাড়ীতে গিয়েছি তার পরের দিন বিকালে একজন লোক আমরা যে ঘরে অবস্থান করছি সে ঘরে ঢুকে পড়লেন। যখন কোন অপারেশনের প্রস্তুতি নিতাম তখন আমরা রাত্রে শেল্টারে ঢুকতাম এবং রাত্রে বের হতাম, দিনে বের হতাম না । যাতে আমাদের অবস্থান গোপন থাকে । ঐ দিন কোন লোক আসার কোন কথা ছিল না। রাতে অভিযান হবে এমন সময় একজন লোক হঠাৎ ঘরে ঢুকে আমাদের অবস্থান জেনে ফেলায় আমরা খুব সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়লাম এবং গোপনীয়তা ফাঁস হয়ে গেল ভেবে আমরা অস্থির হয়ে পড়লাম। এমতাবস্থায় কি করা উচিৎ ভেবে পাচ্ছিলাম না। আমরা সকলে সশস্ত্র ছিলাম। সকলে আমার নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে। তৎক্ষেত্রে আগন্তুক ব্যক্তি আমাদের অবস্থান বুঝে নিয়েছেন। তিনি সহাস্যে আমার দিকে এসে বললেন, ‘তুমি মোহাম্মদ আলী না’? আমি কোন কথা বললাম না। তিনি স্বস্নেহে বললেন, “আমি খুশি হয়েছি, তোমরা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছো, আমি তোমাদের পাশে আছি। এখানে থাকতে কোন অসুবিধা হবে না।” ওনার কথা ও অবয়ব শ্রদ্ধা করার মত ছিল। নিমিষেই আমি সেন্টিমেন্ট দমন করে উঠে দাঁড়াতেই তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি ওনাকে কিছু জিজ্ঞাসা করলাম । তিনি আমাকে নিয়ে ঘর থেকে বের হলেন, এরপর তিনি চলে গেলেন। তখন শেল্টার পরিবর্তন করব কিনা চিন্তা করছিলাম, সন্ধ্যায় শেল্টারদাতা আসলে তাকে একচোট নিলাম, কেননা নির্দেশ ছিল কোন লোক যাতে না আসে তার ব্যবস্থা করার জন্য। এখন একজন লোক এসে দেখে গেল। এখানে আর থাকা যাবে না। সেল্টারদাতা বলেলন, উনি এডভোকেট য়্যাহ্য়্যা সাহেব এ বাড়ীর মালিক। তাঁর অনুমতি নিয়ে আমাদেরকে রেখেছেন। আমরা খুবই লজ্জিত হলাম । শেল্টার দাতাকে বললাম আপনি সাথে এসে উনার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া উচিৎ ছিল । এ রকম পরিস্থিতিতে যে কোন দুর্ঘটনা ঘটে গেলে কি হত। এরপর বিভিন্ন কারণে গ্রুপ নিয়ে বেশীর ভাগ সময় গুমানমর্দন ও নাঙ্গলমোড়া এলাকায় কাটাতে হয়েছে। তাঁর সাথে আমার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল। তিনি আমাদের থাকা খাওয়ার নিয়মিত খোঁজখবর নিতেন। তিনি বৃহত্তর গুমানমর্দন ইউনিয়নের একজন সফল চেয়ারম্যান ছিলেন। চেয়ারম্যান থাকার সুবাদে হাটহাজারী থানার অনেক কিছু তিনি জানতেন বিধায় তাঁর সহায়তায় হাটহাজারী থানার অনেক জায়গায় অভিযান চালানো সম্ভব হয়েছে। তাঁর ছোট ভাই আবু মোহাম্মদ এমরান ও চাচাতো ভাই মোঃ রফিকও বীর মুক্তিযোদ্ধা । তার পুরো পরিবার স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রাখে । মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য নিজ গ্রামের সংখ্যালঘুরা তাঁকে ২টি স্বর্ণ পদক ও নগদ অর্থ পুরস্কৃত করেন । দীর্ঘদিন নয় মাস তিন বুদ্ধিমত্তা ও সাহসিকতার মাধ্যমে উক্ত গ্রামকে রাজাকার ও হানাদার মুক্ত রাখেন ।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর উনার সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। আমি তাঁকে বড়ভাই হিসাবে সম্মান করতাম। ১৯৭৯ সালে ফৌজদারী সাইড দিয়ে আমার আইনপেশা শুরু হয়েছে। আমার শ্রদ্ধাভাজন সিনিয়র এডভোকেট আবু মোহাম্মদ য়্যাহ্য়্যা আমাকে সিভিলের দিকে টেনে এনেছেন। তিনি হাতে কলমে আমাকে কাজ শিখিয়েছেন। তিনি আমাকে সব সময় উৎসাহ যুগিয়েছেন। উনার উৎসাহ ও প্রেরণায় সিভিল সাইডে টিকে থাকা এবং প্রতিষ্ঠা লাভ করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছে। আমি মামলার আর্জি ও জবাব লিখে ওনার কাছে নিয়ে গেলে তিনি বেশী কাটাকাটি না করে যতটুকু সম্ভব আমার লিখাটা ঠিক রাখার চেষ্টা করতেন। ভুল হলে আমাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতেন। কোন মক্কেল আমার থেকে আর্জি জবাব লিখিয়ে উনার কাছে নিয়ে গেলে তিনি বলতেন, ‘খুব সুন্দর হয়েছে এখানে কারেকশন করার কিছু নেই’। এনেছেন যখন রেখে যান কাল পরশু পরে এসে নিয়ে যাবেন। মক্কেলকে এমন ধারণা দিতেন যেন আমি সবকিছু করেছি। সিনিয়রের কথায় মক্কেল আমার উপর অনেক খুশী হতেন এবং আমার উপর তাদের আস্থা বেড়ে যেত। আমার কোন লিখা তিনি মক্কেলের সামনে সংশোধন করতেন না, বেশী ভুল হলে আমাকে ডেকে আমার দ্বারা পুনরায় লিখাতেন এবং পরের দিন তিনি মক্কেলকে ফেরৎ দিতেন। আমার লিখিত আর্জি জবাব দেখে দেওয়ার জন্য মক্কেল থেকে তিনি ফিস নিতেন না। আমাকে ফিস দেওয়ার জন্য মক্কেলকে বলতেন। তিনি জুনিয়র কৌসুলীদেরকে খুব স্নেহ করতেন। তার মধ্যে পরশ্রীকাতরতা ছিল না। এ ধরনের উদার, মহৎ ও হৃদয়বান সিনিয়র এর এখন খুবই অভাব। আজ মুক্তকণ্ঠে বলতে পারি, আমার সিনিয়র এডভোকেট মরহুম আবু মোহাম্মদ য়্যাহ্য়্যা একজন আদর্শবান পরহেজগার ও সৎ চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। আইনের উপর উনার অপরিসীম দক্ষতা ছিল । মামলা করার সময় তিনি প্রতি ক্ষেত্রে আইনের রেফারেন্স দিয়ে শুনানি করতেন। তিনি ২০০৭ সালের ৬ই মে মহান আল্লাহ্ তায়ালার তাকে সাড়া দিয়ে চলে যান । তাঁর একমাত্র পুত্র জিয়া হাবীব আহ্সান ও একজন স্বনামধন্য লেখক ও মানবাধিকার আইনবিদ এবং কন্যা জান্নাতুন নাঈম রুমানা ও একজন বিশিষ্ট এডভোকেট ১৭ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমার সিনিয়র জনাব এডভোকেট আবু মোহাম্মদ য়্যাহ্য়্যাকে শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি এবং মহান আল্লাহ্ কাছে প্রার্থনা করছি। আল্লাহ্ যেন তাকে জান্নাতবাসী করেন। আমীন ।

লেখক: সাবেক সিনিয়র সহ সভাপতি, ‘চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি’।
সভাপতি, আওয়ামী লীগ, হাটহাজারী উপজেলা শাখা।
সভাপতি, বালাদেশ হিউম্যান রাইট্স ফাউন্ডেশন, হাটহাজারী উপজেলা শাখা।
সভাপতি, হাটহাজারী দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি (দুদক নিয়ন্ত্রিত) চট্টগ্রাম।
চেম্বার রুম নং-৪৪৬ আইনজীবী এনেক্স ভবন-১, কোর্টহিল, চট্টগ্রাম।

মন্তব্য করুন