মোঃ ছরওয়ার কামাল: চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় এক আওয়ামী লীগ কর্মীকে ছুরিকাঘাত করে খুন করার ৪৮ ঘণ্টা পার না হতেই কয়েক দফা পিটিয়ে সদ্যবিবাহিত এক পিকআপচালককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
বুধবার (২৯ মে) রাত ৮টার দিকে সাতকানিয়ার আমিলাইশ ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড দক্ষিণ আমিলাইশ শাহ পারওয়াল বাড়ি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। সন্ধ্যা ৬টার দিকে পিকআপচালককে গাড়িসহ আটক করে কয়েক দফা পেটানোর পর মো. মহিউদ্দিন (২৫) নামে ওই যুবক মারা যান। স্থানীয়দের কেউ কেউ একে ‘গণপিটুনির ঘটনা’ বললেও অনেকে বলছেন, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এর একদিন আগে উপজেলার ছদাহা ইউনিয়নে ছুরিকাঘাতে মোহাম্মদুল হক (৩৩) নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মীকে পেটে ছুরিকাঘাত করে খুন করা হয়। নিহত মোহাম্মদুল গত সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রার্থীর এজেন্ট ছিলেন। বুধবার রাতে নিহত যুবক মহিউদ্দিন উপজেলার ছদাহা ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ড সর্দারপাড়া লম্বা কালুর বাড়ির আলী আহমদের ছেলে।
মহিউদ্দিনের মা রোকসানা আকতার বলেন, ‘আমার ছেলে একজন পিকআপ চালক। গত কয়েকদিন ধরে একটি ধানের ভাড়ার জন্য আমিলাইশ ইউনিয়নের সরওয়ার বাজার থেকে তাকে কল দিচ্ছে বলে আমাদেরকে জানায়। বুধবার (২৯ মে) সকাল ১০টায় সে গাড়ি নিয়ে ঘর থেকে বের হয় এবং রাত আনুমানিক ৮ টার দিকে ধান লোড করতে সরওয়ার বাজার গিয়েছে বলে জানতে পারি। পরে রাত সাড়ে ৯টার দিকে আমার মোবাইলে একটি কল আসে। মোবাইলের অপর প্রান্ত থেকে আমার ছেলে বলে উঠে ‘মা আমাকে বাঁচাও, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।’ এটি বলার পরপরই কলটি কেটে যায়।
রোকসানা বলেন, ‘আমার ছেলের বিয়ে হয়েছে মাত্র ২২ দিন। আমার ছেলে নিরপরাধ। আমি ছেলে হত্যার বিচার চাই।’ নিহত মহিউদ্দিনের সহকর্মী গাড়িচালক নবী হোসেন নাহিদ জানান, ‘বুধবার সন্ধ্যার দিকে কেরানিহাট গরু বাজারের সামনে থেকে মিলে ধান নেওয়ার জন্য কল দিয়ে তাকে (মহিউদ্দিন) নিয়ে যাওয়া হয়। তাৎক্ষণিক সে গাড়ি নিয়ে ভাড়ার জন্য বের হয়। একপর্যায়ে এক অপরিচিত মোবাইল ফোন নম্বর থেকে আমার মোবাইলে কল আসে মহিউদ্দিন এখনও ধান নিতে আসেনি। সাথে সাথে আমি মহিউদ্দিনকে কল দিলে তার মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
’নিহত মহিউদ্দিনের প্রতিবেশী আবদুল মান্নান জানান, ‘রাতে হঠাৎ করে এক পরিচিত লোকের মাধ্যমে জানতে পারি মহিউদ্দিনের লাশ সরওয়ারবাজারের কাছেই রাস্তার ধারে পড়ে আছে। সাথে সাথে তার পরিবারসহ আমরা গিয়ে লাশটি শনাক্ত করি। এ সময় লাশের আশপাশে কোন মানুষজন ছিল না। বিষয়টি সাতকানিয়া থানা পুলিশকে জানালে তারা এসে লাশটি উদ্ধার করে।
’সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার ডা. সাদত ইসলাম মিরাজ বলেন, ‘বুধবার রাত ৩ টায় পুলিশ এক যুবককে হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগে নিয়ে আসে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে হাসপাতালে নিয়ে আসার প্রায় ৪-৫ ঘণ্টা আগে ওই যুবক মারা গেছে। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।’ এলাকায় সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানা যায় ভিন্ন ভিন্ন কথা।
স্থানীয়দের মধ্যে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জানান, আমিলাইশ শাহ পারওয়াল মাদ্রাসার নতুন ভবনে স্থানীয় কৃষক ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবের কারণে সায়েম, কামরুল, আইয়ুব ও হেলাল জমি থেকে অগ্রিম ধান কেটে বস্তাভর্তি করে রাখে। গত শুক্রবার (২৫ মে) সকালে পিকআপে করে সুযোগ বুঝে ২০ বস্তা ধান নিয়ে যায় চোরের দল। এ সময় ধানের মালিকরা মনে করেন, তাদের মধ্যে যে কেউ ধান বিক্রি করে দিয়েছে, সেই ধান ক্রেতারা নিয়ে গেছে । পরে ধানের মালিকরা এক হলে বুঝতে পারে তাদের ধান চুরি হয়ে গেছে। বুধবার রাতে একটি পিকআপে করে আবার ধান চুরি করতে গেলে আগে থেকে সজাগ থাকা জনতা চোরদের ধাওয়া করলে তিন চোর পালিয়ে যায়। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা চালক মহিউদ্দীনকে গণপিটুনি দিলে ঘটনাস্থলে তিনি মারা যান। এ সময় জনতা পিকআপটি ভাংচুর করে।
তবে ছদাহা ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মুজিবুর রহমান মুজিব বলেন, ‘পিকআপচালক মহিউদ্দিনকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। সে কখনও এ ধরনের কার্যকলাপের সাথে যুক্ত থাকতে পারে না। না জেনে হয়ত সে ভাড়ায় গিয়েছিল তাই চোরের দল পালিয়ে গেলেও সে গাড়িতে বসে ছিল। তাঁকে গণপিটুনিতে মেরে ফেলা হয়েছে। এটি একটি অমানবিক ঘটনা।’
অপরদিকে স্থানীয় ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য লোকমান হাকিম মনু বলেন, ‘বুধবার রাত সাড়ে ৮টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত তিন স্থানে কয়েক দফায় শারীরিক নির্যাতন করা হয় চালক মহিউদ্দিনকে।’
অন্যদিকে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মো. মহিউদ্দিন জানান, ‘আনুমানিক ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী ১০-১২ জন যুবক এক ব্যক্তিকে পেটাচ্ছিল। এদের মধ্যে হেলাল, মিনহাজ, জিহান, বাবুল ও কামরুলকে আমি চিনতে পেরেছি।’
সাতকানিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রিটন সরকার বলেন, ‘এক সপ্তাহ পূর্বে ২০ বস্তা ধান চুরি হয়েছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তারা পাহারা বসিয়েছিল। এ অবস্থায় চোরের দল ৫ বস্তা ধান গাড়িতে তোলে। এ সময় পাহারায় থাকা লোকজন এগিয়ে আসলে চোরের দল পালিয়ে যায়। পরে গাড়িতে থাকা চালককে গণপিটুনি দেয় উত্তেজিত জনতা। এতে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’