মো: ছরওয়ার কামাল: চট্টগ্রাম নগরীতে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের দফায় দফায় সংঘর্ষে অন্তত তিনজন নিহত এবং বিকেল ৫টা পর্যন্ত ৬০ জনেরও বেশি আহত শিক্ষার্থীকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নেওয়া হয়েছে। আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা এমনই করুণ যে, নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে বিভিন্ন সূত্রে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
নিহত তিনজনের মধ্যে একজন চট্টগ্রাম কলেজের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র এবং অন্য দুজনের একজন একটি ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী, পিঠে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত অপর একজনের বিস্তারিত পরিচয় মেলেনি। এদিকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা সংঘবদ্ধ হয়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের দুই অস্ত্রধারীকে ধরে গণপিটুনি দিয়েছে। এদের অবস্থাও গুরুতর বলে জানা গেছে। আহত শিক্ষার্থীদের আর্তচিৎকারে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক নারকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ভ্যানগাড়ির মধ্যে মালামালের বস্তা নেওয়ার মতো করে একের পর এক আহত শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসা হচ্ছে। পরিস্থিতি সামলাতে জরুরি বিভাগে ডাক্তার ও নার্সরা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন। চিকিৎসা ছাড়াই গুরুতর আহত অনেক শিক্ষার্থীকে ভ্যানের ওপর পড়ে থাকতে দেখা গেছে। আহত শিক্ষার্থীদের স্বজনদের ভিড়ে চিকিৎসাও ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কর্তব্যরত নার্সরা। চট্টগ্রামে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২ নং ওয়ার্ড ক্যাজুয়ালিটি ওয়ার্ডে ছাত্রলীগ নেতাদের ভিড়ের কারণে ডাক্তার-নার্সরা আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা দিতে সমস্যায় পড়ছেন বলে জানা গেছে।
আজ মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) বেলা তিনটার পর থেকে চট্টগ্রাম নগরীর ষোলশহর-মুরাদপুর এলাকায় গুলি ছুঁড়ে তিনজনকে হত্যা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। বিকেল সাড়ে ৫টায় এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মুরাদপুর ফরেস্ট গেট এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে সংঘর্ষ চলছিল। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে টানা সংঘর্ষে ছাত্রলীগ-যুবলীগের অনেক নেতাকর্মীকে প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে গুলি চালাতে দেখেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে ককটেলও ছুঁড়ে মারা হয়। অন্যদিকে পুলিশও শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে রাবার বুলেট ও কাদাঁনে গ্যাসের সেল ছুঁড়েছে।
জানা গেছে, চট্টগ্রামের মুরাদপুরের সংঘর্ষে নিহত ওয়াসিম আকরাম (২২) চট্টগ্রাম কলেজের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। তার বাড়ি কক্সবাজারের পেকুয়ায়। অন্যদিকে ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী ফারুকের (৩২) বাড়ি নোয়াখালীতে। মুরাদপুরের বিসমিল্লাহ হোটেলে নাস্তা করে বের হতেই একটি গুলি ওড়ে এসে তার বুক বিদীর্ণ করে চলে যায়। সেখানেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এছাড়া মৃত অবস্থায় আরও একজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নিয়ে আসা হয়েছে। ২৪ বছর বয়সী ওই যুবকের নাম ফিরোজ বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। তিনি পিঠে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এছাড়া আরও একজনের নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে— এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ নুরুল আলম আশেক এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘তিনজনের বাইরে আমরা আর কোনো লাশ এখন পর্যন্ত পাইনি।’ চট্টগ্রাম মেডিকেলের বারান্দায় বসে নিহত ওয়াসিমের বন্ধু আবির বলেন, ‘আমরা চারজন আজকে সকালে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করবার জন্য মুরাদপুরে চলে আসি। সেখান থেকে আমরা চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। বেলা চারটার দিকে তখন আমাদের পাশ দিয়ে যাওয়া ছাত্রলীগের মিছিল থেকে গুলি করা হয়। সেখানেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ওয়াসিম। পরে মেডিকেলে আনলে ডাক্তার মৃত বলে জানায়।’
চট্টগ্রাম মেডিকেলে ছুটে আসা নিহত ফারুকের স্ত্রী সীমা আক্তার আহাজারি করতে করতে বলেন, ‘আমার স্বামী সকালে নাস্তা খেয়ে বের হয়েছে। যাওয়ার সময় বলেছে রাতে মুরগি কিনে নিয়ে যাবে। আজকে রাতে দুই বাচ্চার সাথে মুরগির তরকারি দিয়ে রাতে ভাত খাবে। সেই খাবার কই থেকে খাবে আমার বাচ্চারা?’দেশের বিভিন্ন স্থানে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে চট্টগ্রাম নগরীর ষোলশহর রেলস্টেশনে কর্মসূচি ঘোষণা করে শিক্ষার্থীরা। কিন্তু তার আগেই পুলিশের সহায়তায় সেখানে অবস্থান নেন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের একদল নেতাকর্মী। এ সময় বিপুলসংখ্যক লাঠিও সেখানে মজুদ করা হয়।
বেলা সাড়ে তিনটার পর থেকে শিক্ষার্থীরা ষোলশহর রেলস্টেশনের দিকে যেতে থাকে। ঠিক ওই সময়ই আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালাতে থাকে। শুরুতে লাঠি নিয়ে হামলে পড়লেও হামলার একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে ককটেলও ছুঁড়ে মারা হয়। ছাত্রলীগ-যুবলীগের অনেক নেতাকর্মীকে প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে গুলি চালাতে দেখেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
অন্যদিকে গুলি ও ককটেলে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়া আন্দোলনকারী সাধারণ শিক্ষার্থীরা রাস্তায় পড়ে থাকা ইটের ছোট ছোট টুকরো ছুঁড়তে থাকেন। শিক্ষার্থীদের অনেকে গুলিবর্ষণে আতঙ্কিত হয়ে আশেপাশের গলিতে ঢুকে পড়লে সেখান থেকেও তাদের খুঁজে বের করে মারধর করে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা।