তড়িগড়ি করে আওয়ামীদের পদোন্নতি দেয়ার পাঁয়তারা!! আন্দোলনে পদোন্নতি বঞ্চিতরা

নিউজগার্ডেন ডেস্ক: চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে আওয়ামী চেয়ারম্যান সরে যাওয়ার আগে তড়িগড়ি করে আওয়ামীলীগ ও ১৪ দলীয় সন্ত্রাসীদের পদোন্নতি দেয়ার পাঁয়তারা শুরু হয়েছে। এতে ক্ষোভ বাড়ছে পদোন্নতি বঞ্চিত নির্যাতিতদের। এ ঘটনায় সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। তাদের মতে, ‘যে সমস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত যেখানে তাদের শাস্তি হওয়ার কথা সেখানে ওই সমস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি দিয়ে উল্টো পুরস্কৃত করা হচ্ছে। আর এ সমস্ত ঘটনা দুর্নীতিকে আরো উসকে দেয়ারই নামান্তর।’

কোনো প্রতিষ্ঠানে অসৎ কর্মীকে পুরস্কৃত করার অর্থই যে সৎকর্মীকে তিরস্কার করা, তা বলাই বাহুল্য। কেননা চুরি করে পদোন্নতিসহ পুরস্কার যদি চোরের কপালে জোটে, স্বভাবতই সৎকর্মীদের তা আহত করে; প্রতিষ্ঠানের প্রতি তাদের আন্তরিকতা, কর্মনিষ্ঠতা ও সততায় চিড় ধরে এটাই স্বাভাবিক। এ ছাড়া সহকর্মীদের মধ্যে অসাধু উপায় অবলম্বনের উৎসাহ তৈরি হতে পারে। আখেরে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সরকারি এসব প্রতিষ্ঠান। আর সরকারি প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিটা হয় জনগণেরই। এ চিত্র দেশের বেশিরভাগ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় একেবারেই অচেনা নয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় অনিয়ম, দুর্নীতি এবং সেসব অপকর্মের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না হওয়া বিরল ঘটনা তো নয়ই; বরং অসংখ্য ঘটনায় অপকর্মের হোতাদের নানাভাবে পুরস্কৃত করার ঘটনাও কম নেই, যা এক কথায় হতাশার।

চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডে পদোন্নতির একটি প্রক্রিয়া শুরু করেছে বর্তমান আওয়ামী চেয়ারম্যান। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তাদের অধিকাংশ শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডসহ নানা রকমের অনিয়ম ও অসাধুতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অতীতে এসব কর্মকাণ্ডে ধরা পড়ে কিংবা জড়িত প্রমাণ হওয়া সত্ত্বেও তাদের পদোন্নতি দেয়ার পাঁয়তারা করছেন। এমন ব্যক্তিদেরকেও আরও এক ধাপ পদোন্নতি দেওয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন করেছে চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড। এ ছাড়া এই পদোন্নতির ক্ষেত্রে কারও কারও ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না সার্ভিস রেগুলেশনের নীতিমালা; যেমন একই পদে তিন বছর দায়িত্ব পালন না করলে পদোন্নতিযোগ্য নয়, মানা হচ্ছে না সেটাও। যেসব অপকর্মে জড়ানোয় ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয় চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডকে, তাদেরই পদোন্নতি দেওয়ার এ পাঁয়তারা কেন? তৃতীয়ত, এই পদোন্নতির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছেন চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের আওয়ামী চেয়ারম্যান।

আমরা মনে করি, রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি বিশেষের প্রভাব ও খামখেয়ালিতে চলতে পারে না। বিভিন্ন গুরুতর অনিয়মে জড়িত, শাস্তিপ্রাপ্ত এসব অসৎ ব্যক্তিদের পদোন্নতি গ্রহণযোগ্য নয়। এ ছাড়া একই পদে প্রয়োজনের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশিসংখ্যক কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও এই পদোন্নতি যে রাষ্ট্র তথা জনগণের অর্থের অপচয়কেই নিশ্চিত করবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠানে অপরাধীদের এ পদোন্নতির যৌক্তিক ও বাস্তবিক কোনো ভিত্তিই যেখানে আপাতদৃষ্টে স্পষ্ট নয়, সেখানে কোন বিবেচনায় এবং কার স্বার্থে এটি হচ্ছে, তা খুঁজে বের করা জরুরি। আমরা চাই, নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়া এসব ব্যক্তিদের পদোন্নতির এ প্রক্রিয়া স্থগিত করা হউক এবং এতদিন পদ বঞ্চিতদের পদায়ন করা হউক। এতে সংস্থাটিতে অপরাধ ও নীতিবিবর্জিত কাজ নিরুৎসাহিত হওয়ার পাশাপাশি অর্থের অপচয়রোধ সম্ভব হবে।

জানা যায়, চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময় মাত্র ৩২ জন প্রতিষ্ঠাকালীন কর্মচারী নিয়ে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড ১৯৯৬ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা সফলতার সাথে সম্পন্ন করেছে, যা সারা দেশব্যাপী প্রশংসিত হয়েছিল।

১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর উক্ত কর্মচারীদের চাকরী স্থায়ীকরণ না করে দলীয় লোকজন নিযোগ করে। তখন উক্ত কর্মচারীদের চাকরী অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। সুদীর্ঘ ৫ বছর পর ২০০০ সালে তাদের চাকরী স্থায়ীকরণ করা হয়। ২০০৮ সালে ফ্যাসিবাদী সৈরাচার আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর উক্ত কর্মচারীদের প্রাপ্য পদোন্নতি না দিযে রাতের আঁধারে একসাথে ২১ জন দলীয় ক্যাডারদের পত্রিকা বিজ্ঞপ্তি দ্বাড়া দৈনিক ভিত্তিক কর্মচারী হিসাবে নিয়োগ প্রদান করে ফলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা বৈষম্যের শিকার হয় এবং তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। পরবর্তীতে হাইকোর্টের রায়ের কথা বলে উক্ত ক্যাডারদের চাকরী ২০১৫ সালে স্থায়ীকরণ করা হয়। যদিও হাইকোর্টের রায়ে তাদেরকে চাকরী স্থায়ী করণের সুনির্দিষ্ট কোন নির্দেশনা ছিল না বলে জানা যায়।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সাধারণ জনগণের আন্দোলনের মুখে ৫ আগষ্ট সৈরাচার সরকারের পতনের পর এখনও বোর্ডের বিভিন্ন পদে আওয়ামীলীগের ক্যাডার ও লোকজন বহাল তবিয়তে বসে আছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রাষ্ট্র সংস্কারের ছোঁয়া সারাদেশে লাগলেও চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে সরকারের কোন আদেশ-নির্দেশ পালন করা হচ্ছে না।
জানা গেছে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল ইসলাম চৌধুরীর নওফেল এর ক্যাশিয়ার হিসাবে খ্যাত বোর্ডের উপ-সচিব মো: বেলাল হোসেনের হাত ধরে বোর্ডের সাবেক দুর্নীতিবাজ সচিব প্রফেসর রেজাউল করিম চেয়ারম্যান হিসাবে যোগদানের পর নওফেল সিন্ডিকেট টেন্ডারসহ বিভিন্ন দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকা বানিয়েছেন।

বসুন্ধরা থেকে সাবেক সচিব রেজাউল করিম নগদ ৫০ হাজার টাকা গ্রহণ করে পরবর্তীতে পত্রিকায় নিউজ প্রকাশিত হলে উক্ত টাকা বোর্ডের ব্যাংক হিসাবে জমা দেওয়ার মাধ্যমে বাচার চেষ্টা করে। তাছাড়া উপ-সচিব সহ নওফেল সিন্ডিকেট বসুন্ধরা গ্রুপকে একসাথে ১৮ কোটি টাকার টেন্ডার প্রদানের মাধ্যমে ৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে জানা যায়। এমনকি বোর্ডে মেধা কেলেংকারির মত ঘটনাও ঘটেছে যা মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি কর্তৃক প্রমাণিত হওয়ার পর মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার ২১ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরও এখনও বিভাগীয় মামলা করা হয়নি।

সম্প্রতি আওয়ামীলীগের মদদপুষ্ট লোকদের ট্রান্সপারের খবর ছড়িয়ে পড়লে প্রফেসর রেজাউল করিম ও উপ-সচিব মো: বেলাল হোসেন জোট সরকারের আমলে নিয়োগকৃক্ত প্রতিষ্ঠাকালীন বিএনপি জামাতের সমর্থিত কর্মচারীদের ১৮-২১ বছর ধরে পদোন্নতি বঞ্চিত করে রাখার পরও সম্প্রতি তাদেরকে পদোন্নতি না দিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে রাতের আধারে ২০১৫ সালে নিযোগকৃক্ত আওয়ামী ক্যাডারদের আবার রাতের আধারে তড়িগড়ি করে পদোন্নতি দেওয়ার পাঁয়তারা শুরু করেছে। খবরটি ফাঁস হয়ে গেলে বোর্ডে চরম অসন্তোষ বিরাজ করে। এমনকি মিছিল মিঠিং সভা সমাবেশ চলছে বলে জানা যায়। এ ব্যাপারে ১৭ তারিখ ও ২২ তারিখ পদোন্নতি কমিটির মিটিং ডেকেছে বলে জানা যায়।

জানা যায়, অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী পদ না থাকায় পদোন্নতি বন্ধ রয়েছে শিক্ষাবোর্ডে। এর আগে ২০১৯ সালে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। ওই সময় সেকশন অফিসার পদ শূণ্য না থাকলেও অর্গানোগ্রামের বাইরে গিয়ে ছয় কর্মচারীকে সেকশন অফিসার, যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও ডাটা এন্ট্রি কন্ট্রোল অপারেটরকে সহকারী প্রোগ্রামার পদে পদোন্নতি দিয়েছে বলে অভিযোগ করে সংশ্লিষ্টরা। পরবর্তীতে অনিয়মের মাধ্যমে দেওয়া এসব পদোন্নতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ওই বছরের ২০ অক্টোবর মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব ড. মো. মোকছেদ আলীর সই করা এক চিঠিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পূর্ব অনুমতি ছাড়া এসব পদোন্নতির যৌক্তিক কারণ উল্লেখ করে লিখিতভাবে জানাতে বোর্ড চেয়ারম্যানকে নির্দেশনা দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে জানতে বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেজাউল করিম চৌধুরীকে ফোন করেও তার কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

উল্লেখ্য যে, জোট সরকারের আমলে নিযোগকৃত কর্মচারীরা মন্ত্রণালয়ের ন্যায় ইনসিটু সহ তাদের পদোন্নতি প্রদানের দাবী জানিয়ে আসলেও তা অমলে না নিযে আওয়ামী চেয়ারম্যান চলে যাওয়ার আগে শুধুমাত্র আওয়ামীলীগ আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীদের লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে পদোন্নতি প্রদানের পাঁয়তারা করছে বলে জানা যায়।

আরও জানা যায়, নওফেলের ক্যাশিয়ার হিসাবে পরিচিত উপ-সচিব মো: বেলার হোসেন ও বিদ্যালয় পরিদর্শক ড. বিপ্লব গাঙ্গুলী কোতোয়ালী থানাসহ বিভিন্ন থানায় মার্ডার কেইসের আসামী হওয়ার পরও এখনও তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি মর্মে জানা যায়।

বেলাল হোসেনের মামলা নং-৬২৭/২৪ এবং বিপ্লব গাঙ্গুলীর মামলা নং-৬৪০/২৪ (কোতোয়ালী থানা)। তারা বিভিন্ন মহলে লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে উক্ত মামলা ঠেকিয়ে রেখেছে এবং নাম বাদ দেওয়ার তদবির করতেছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। বর্তমানে বোর্ডে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে।
এদিকে, সরকার পতনের পরে গেল কয়েকদিন ধরে পদোন্নতির বিষয়টি নতুন করে সামনে আসে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে। এ সময় বোর্ড চেয়ারম্যানকে পদোন্নতির কার্যক্রমে গতি আনতে তাগাদা দেন বঞ্চিতরা। শেষে দাবি আদায় না হওয়ায় আন্দোলনে নামেন পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

মন্তব্য করুন