
নিউজগার্ডেন ডেস্ক: গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য,জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, “বারে বারে এদেশে অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে, প্রতিটির পর কিছু প্রাথমিক অগ্রগতি ঘটেছে,কিন্তু কোনোবারেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আকাক্ষিত পরিবর্তন আসেনি।এ থেকে হতাশ না হয়ে এর কার্যকারণ অনুসন্ধান করাটা জরুরী।কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ তাদের স্বার্থে যদি ঐক্যবদ্ধ না হয়, তাদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি গড়ে না উঠে, তাহলে ৭১, ৯০ এর মতো ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের সুফল থেকেও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বঞ্চিত হবে, সত্যিকারের আকাক্ষিত পরিবর্তন হবে না। এজন্য আজ প্রয়োজন সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের সংগঠিত শক্তি ও অবস্থান গড়ে তোলা।”
আজ ২ নভেম্বর, বিকালে চট্টগ্রাম নগরের থিয়েটার ইনস্টিটিউটে আয়োজিত ‘গণঅভ্যুত্থানের আকাক্ষা,পর্যালোচনা ও করণীয়’ শীর্ষক আলোচনাসভায় আনু মুহাম্মদ এসব কথা বলেন। গণতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলনের উদ্যোগে এ আলোচনাসভা ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।
গণতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলনের আহবায়ক সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক তাহুরিন সবুরের সভাপতিত্বে ও যুগ্মআহবায়ক দীপা মজুমদারের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত আলোচনাসভায় আরো বক্তব্য রাখেন সংগঠনের যুগ্মআহবায়ক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ও অনুবাদক জি এইচ হাবীব,চ বি শিক্ষক মুনমুন নেসা চৌধুরী,সুফি স্পিরিচ্যুয়াল ফাউন্ডেশনের খাজা ওসমান ফারুকী,এডভোকেট হাফিজ আহমেদ, শহীদ ওয়াসিম আকরামের পরিবারের সদস্য মোঃ জোবায়ের, আন্দোলনকারীদের শিক্ষার্থী প্রতিনিধি পুষ্পিতা নাথ, সিয়াম এলাহী।
আনু মুহাম্মদ বলেন, গত ১৫ বছরে জনগণের দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছে গণঅভ্যুত্থানে। আন্দোলনের ফসল অন্তর্র্বতী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার তিন মাস হতে যাচ্ছে। শুরুতেই তাদের করণীয় বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল, যার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি চোখে পড়ছেনা। প্রথমত,তাদের দায়িত্ব ছিল আন্দোলনে নিহত ও আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা,সরকার যা তিনমাসেও পূর্নাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করতে পারেনি। নিহতদের পরিবার, আহতদের চিকিৎসার সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব নেওয়ার কথা ছির সরকারের।কিন্তু সেখানেও অবহেলা, শৈথিল্য দেখছি।আমরা এ থেকে খুব উদ্বিগ্ন,আবারও কি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে?সরকার কি সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ডিসি, ইউএনওদের নির্দেশ দিতে পারতেননা,দ্রুত খোঁজ নিয়ে তালিকা জমা দেওয়ার জন্য? দ্বিতীয়তঃ একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল আইনশৃঙ্খলা,সর্বস্তরের জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।কিন্তু শ্রমিকদের উপর গুলি, জাতীয় ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর সাম্প্রদায়িক আক্রমণ, মাজার ভাঙ্গা, মব জাস্টিস, ভিন্ন মতের উপর আক্রমণ কোনো মতামত, লেখা, বক্তব্য, পরিচয়ের কারণে নির্যাতন,নিরাপত্তাহীনতা – এগুলো দেখছি।
তৃতীয়তঃ গত ১৫ বছরে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীর কারণে মূল্যবৃদ্ধিতে জনগণ চরম দুর্ভোগে ছিল।সিন্ডিকেট ভাঙ্গার জন্য তিনমাস যথেষ্ট ছিল,কিন্তু সে জায়গায় সরকারকে আমরা হাত দিতে দেখিনি রাষ্ট্রে বা সমাজে চার ধরনের বৈষম্য দূর না হলে গণতান্ত্রিক শাসন সম্ভব হবে না বলে মনে করেন এই অধ্যাপক।
তিনি বলেন, এই চার ধরনের বৈষম্য হলো শ্রেণিগত, জাতিগত, ধর্মীয় এবং লৈঙ্গিক বৈষম্য।এ চার ধরণের বৈষম্যেরই তীব্র, বিষময় রূপ আমরা দেখছি। অন্তর্র্বতী সরকার এসব বৈষম্য দূর করার কোনো আলোচনা এখনো শুরু করেনি। এ বৈষম্য দূর করার উদ্যোগ শুরু করা ছাড়া বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্লোগান অর্থহীন।”
আনু মুহাম্মদ বলেন, জিডিপির বিষয়ে সবাই জানেন যে এটা একটা গোঁজামিলের হিসাব। শ্রমজীবী মানুষ কতটুকু অবদান রাখছেন আর রাষ্ট্র তাঁদের জন্য কতটুকু বরাদ্দ করছে, তার স্বচ্ছ হিসাব পাওয়া যায় না। যেটুকু পাওয়া যায়, তাতে আকাশ সমান বৈষম্য রয়েছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়তে হলে শ্রমজীবীদের দাবি বাস্তবায়ন করতে হবে।শ্রমিকদের জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে এ সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে।”
আনু মুহাম্মদ পোশাক শ্রমিকদের উপর গুলি চালনার নিন্দা জানিয়ে বলেন,গণঅভ্যুত্থানে শত শত শ্রমিক জীবন দিয়েছে,অথচ আজ তারা তাদের বকেয়া বেতনের দাবি জানাতে গেলে সরকার গুলি করছে।শ্রমজীবি মানুষের উপর গুলি চালনা গণঅভ্যুত্থানের আকাক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত।
চবি শিক্ষক জিএইচ হাবিব বলেন,“আমরা যেন বিগত ১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট সরকারের নিপীড়ন-রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস,জুলাই আন্দোলনে ভয়াবহ আক্রমণ,হত্যাযজ্ঞ ভুলে না যাই।একই সাথে অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা,ন্যায়কে ন্যায়-অন্যায়কে অন্যায় বলা জারি রাখতে হবে।গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে কথা বলা,রাষ্ট্র ও সমাজের প্রগতিমুখী সার্বিক পরিবর্তনের আকাক্ষা জারি রাখতে হবে। গণতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলন সে লক্ষে জনগণকে সংগঠিত করার কাজ করবে,এ প্রত্যাশা করি।”
চবি শিক্ষক মুনমুন নেসা বলেন,বাংলাদেশ বহু সংস্কৃতি- বৈচিত্র্যের দেশ।ঐতিহাসিকভাবে নানা ধর্ম-মত নিয়ে একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে উঠেছিল।এখানে ইসলামের মধ্যে সুফীবাদী ধারার প্রভাব থাকায় উদারতা,সহনশীলতা,অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল।কিন্তু প্রথমে ব্রিটিশ,পরবর্তীতে শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মের নামে মানুষকে বিভক্ত করেছে,উগ্রবাদকে আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে আজকের অবস্থায় এনেছে। অন্তর্র্বতীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দেখলাম কয়েকমাসে অনেকগুলো মাজার ভাঙ্গা হয়েছে।কিন্তু সরকার এ ধরণের উগ্রতা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।সত্যিকার বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গড়তে চাইলে,অর্থনৈতিক বৈষম্য,অন্যন্য বৈষম্য দূর করার পাশাপাশি ধর্মীয় বৈষম্যও দূর করায় সরকারের উদ্যোগ নিতে হবে।”
খাজা ওসমান ফারুকী বলেন,“সত্যিকার বৈষম্যহীন বাংলাদেশ করতে হলে,সবাইকে নৈতিকভাবে পরিশুদ্ধ হতে হবে।”
শহীদ ওয়াসিম আকরামের পরিবারের সদস্য মোঃ জোবায়ের বলেন, শহীদ ওয়াসিম আকরাম ছিলেন খুব বন্ধুবৎসল, পরোপকারী ও মানবদরদী।তিনি অসুস্থ শরীর নিয়েও আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন।আমাদের পরিবার শহীদ ওয়াসিমসহ সকল শহীদের হত্যাকান্ডের দ্রুত বিচার হোক,সে অপেক্ষায় আছি।”
এড হাফিজ আহমেদ বলেন, “দীর্ঘ ১৫ বছর আমরা কথা বলতে পারিনি।আজ যে আমরা কথা বলতে পারছি,তা ছাত্র- জনতার গণঅভ্যুত্থানের ফসল।আইনজীবি হিসেবে দেখেছি,বিচারঙ্গনে ফ্যাসিবাদী শাসনে কিভাবে আইনের শাসনকে প্রতিনিয়ত পদদলিত করা হয়েছে,বিচারকরা কিভাবে সরকারের অঙ্গুলিনির্দেশে রায় দিয়েছন,দলীয়ভাবে পিপি- জিপি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।দুঃখজনক বর্তমান অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের সময়েও একইভাবে সততা,যোগ্যতা বিবেচনা না করে বিভিন্ন দলীয় আইনজীবিদেরকে সরকারি আইনজীবি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।সরকার তিনমাসে সব কাজ করতে পারবেন তা নয়,কিন্তু অন্তত সরকারী আইনজীবি নিয়োগে সার্চ কমিটি করে স্বচ্ছ নিয়োগ দিতে পারতেন।সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক তহুরীন সবুর বলেন গণঅভ্যুত্থানের আকাক্ষা বৈষম্যহীন,গণতান্ত্রিক,অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও সমাজ নির্মাণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্খাকে সমুন্নত রাখা ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার লক্ষ্যে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য গণতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলন কাজ করবে।
আলোচনাসভা থেকে জুলাই গণহত্যার বিচার, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নিহতদের পরিবার ও আহতদের আর্থিক সহযোগিতা ও পুনর্বাসন, চট্টগ্রামে শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ,সিন্ডিকেট ভেঙে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের দাবি জানান।