২৪-এর গণঅভ্যুত্থান, বহুমুখী নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক ভারসাম্যের প্রয়োজনীয়তা

এবিএম ইমরান: বাংলাদেশের রাজনীতিতে ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। এই বিপ্লবে ডান, অতি ডান, এবং মধ্যপন্থিদের যৌথ নেতৃত্বে একটি বিশাল গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল, যেখানে বৈষম্যের শিকার বা সংক্ষুব্ধ কিছু বাম এবং অতি বামপন্থীরাও সংযুক্ত হয়েছিল। যদিও এরা সংখ্যায় কম ছিল, তবুও তাদের ভূমিকা অগ্রাহ্য করা যায় না। এ বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী বামপন্থীরা একসময় আওয়ামী লীগের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখত, যা ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। তবে, জুলাই বিপ্লবে তাদের অংশগ্রহণও সমানভাবে সত্য।

বামপন্থীদের আদর্শ ও আওয়ামী লীগের সাথে সম্পর্ক:

বামপন্থীদের আদর্শের সাথে আওয়ামী চিন্তাধারার কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তারা প্রগতি ও ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতার চর্চা করেছে। তবে, ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে ডান ব্লকের নেতৃত্বে একটি বিজয় অর্জনের পর তারা তাদের পুরোনো আদর্শ থেকে সরে আসবে এটা ভাবা শুধু অমূলক নয়, বরং ক্ষতিকরও। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীন চিন্তা-চেতনার সাথে কখনোই জাতীয়তাবাদ এবং ইসলামী মূল্যবোধের সমন্বয় সম্ভব নয়। এ দুই ধরনের আদর্শে মৌলিক পার্থক্য রয়ে গেছে।

যুগপৎ আন্দোলনের সফলতা:

যদিও বাম এবং ডানপন্থীদের আদর্শিক পার্থক্য সুস্পষ্ট, তবুও রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে যুগপৎ আন্দোলন করা সম্ভব। ২৪-এর ছাত্রজনতার বিপ্লব এটি প্রমাণ করেছে। সেই কারণে বিপ্লবী সরকারে গুটিকয়েক বাম চিন্তার মানুষের উপস্থিতি কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। বিপ্লবী সরকারের জন্য চরম বিরোধী মত বাদ দিয়ে রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য কিছু ভিন্ন মতাবলম্বীকে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। ড. ইউনুস এই ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন।

রাজনৈতিক সমঝোতার অভাব এবং ডান ব্লকের প্রতিক্রিয়া:

চরম ডান ব্লক এই সমঝোতা মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। ফারুকীসহ কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে তাদের প্রতিক্রিয়া সহনশীলতার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এর মাধ্যমে দেখা যায় যে, রাজনীতিতে এডজাস্টিবিলিটি এবং ফ্ল্যাক্সিবিলিটি কমে আসছে, যা রাষ্ট্রের জন্য একটি অশনিসংকেত। ফ্যাসিস্ট পলায়নপর শক্তি এই বিভাজনকে কাজে লাগিয়ে অস্থিরতার পরিবেশ তৈরি করতে চায়।

ফ্যাসিবাদের উত্থান ও মতবিরোধের রাজনীতি:

রাজনীতিতে ছোটখাটো মতপার্থক্য ও ভুল বোঝাবুঝি একত্রিত করে বিরোধ উস্কে দেওয়া ফ্যাসিবাদীদের প্রচলিত কৌশল। তারা বিভেদ সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজকে দুর্বল করতে চায় এবং নিজেদের স্বার্থ হাসিলের সুযোগ খোঁজে। এই অবস্থায় রাজনৈতিক সহনশীলতা এবং ধৈর্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। বীরশ্রেষ্ট আবু সাঈদ, মুগ্ধ ও ওয়াসিমদের রক্তের স্রোতে গড়ে ওঠা এই বিজয়কে স্থায়ী করতে হলে আমাদের সবাইকে আরও সহনশীল হতে হবে।

রাজনৈতিক সংস্কার ও যুগপৎ প্রচেষ্টার প্রয়োজন:

বুদ্ধিমত্তার সহিত সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। বিএনপি এই আন্দোলনের অন্যতম সঙ্গী, জামায়াত বিপ্লবের সারথি, এবং ছাত্রজনতা এই সংগ্রামের মূল সংগঠক। এ বিপ্লবের সফলতার জন্য রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। কোনো দল বা গোষ্ঠীকে এককভাবে দায়িত্ব দেওয়া ঠিক হবে না, বরং সমগ্র জাতির অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করাই হবে সঠিক পদক্ষেপ।

ড. ইউনুসের নেতৃত্বে সময়ের প্রয়োজন:

ড. মোহাম্মদ ইউনুস, যিনি বর্তমান বিপ্লবী সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তার নেতৃত্বে দেশের চলমান সংকটের সমাধান এবং স্থিতিশীলতা আনতে সময় প্রয়োজন। তার নেতৃত্বে এই বিপ্লবকে সফল করার জন্য তাকে যৌক্তিক সময় দেওয়া উচিত। ড. ইউনুসের নেতৃত্ব দেশের রাজনৈতিক সমঝোতা এবং ঐক্যের প্রতীক হতে পারে।

রাজনৈতিক সহনশীলতার গুরুত্ব:

বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক সহনশীলতার অভাব একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমঝোতার মাধ্যমে মতপার্থক্য সমাধান করতে হবে। একে অপরের মতামত শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করে, পার্থক্যগুলোকে ইতিবাচক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা প্রয়োজন। একতা এবং সহনশীলতা ছাড়া কোনো বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থান সফল হওয়া সম্ভব নয়।

জাতীয় ঐক্যের পথে অগ্রসর হওয়া:

জাতীয় উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের স্থিতিশীলতার জন্য রাজনৈতিক সমঝোতা অপরিহার্য। এই বিপ্লব আমাদের শিখিয়েছে যে, ডান, বাম, এবং মধ্যপন্থীদের সমঝোতার মাধ্যমে একটি বৃহৎ রাজনৈতিক আন্দোলন সফল হতে পারে। জাতীয় ঐক্য রক্ষার জন্য সকল পক্ষকে একত্রে কাজ করতে হবে।

২৪-এর গণঅভ্যুত্থান আমাদের দেখিয়েছে যে, ভিন্ন মত ও আদর্শ থাকা সত্ত্বেও একসাথে কাজ করা সম্ভব। এই আন্দোলনের মূল চেতনা বজায় রেখে একটি স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। জাতিকে সামনে এগিয়ে নিতে হলে, আমাদের সহনশীলতা এবং উদারতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং রাজনৈতিক সংকটের সমাধানে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
লেখক: সদস্য সচিব, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রজনতা ও সাংবাদিক ঐক্য পরিষদ।

মন্তব্য করুন