টেন্ডার, বদলি ও নিয়োগ বাণিজ্য সাবেক মহাপরিচালকের ইশারায়

নিউজগার্ডেন ডেস্ক: মৎস্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক খন্দকার মাহবুবুল হক। ২০২১ সাল থেকে তিনবছর মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ওই সময়ে এই দফতরের আওতায় সারাদেশে অন্তত ৫ হাজার কোটি টাকার প্রকেল্পর কাজ বাস্তবায়ন করা হয়।

এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা, ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশ করে এসব প্রকল্পের কাজ নয়ছয় করে হাতিয়ে নিয়েছেন হাজার কোটি টাকা। নামে-বেনামে সম্পদ গড়ার পাশাপাশি অনিয়মের বিশাল অংকের অর্থ বিদেশেও পাচার করেছেন— এমন অভিযোগ উঠেছে সাবেক এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।

অভিযোগ রয়েছে, সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের অতি ঘনিষ্ঠজন ছিলেন খন্দকার মাহবুবুল হক। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে অবসরে যান তিনি।

অবসরে গেলেও পূর্বে কর্মকর্তাদের সঙ্গে রয়েছে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। তাদের সঙ্গে আতাঁত করে গোপনে নিয়ন্ত্রণ করছেন অধিদপ্তরের বেশ কিছু কাজ। টেন্ডার, বদলি ও নিয়োগ বাণিজ্য তার ইশারায় চলছে এখনও। তার সবুজ সংকেট না পেলে দফতরের কোনো ফাইলও নড়ে না। এমনকি মন্ত্রণালয়ে কোন ফাইল পাঠাতে হবে, প্রকল্পের বাজেট কত হবে, এসব যেন তার অদৃশ্যে ইশারায় চলছে।

গত ৫ আগস্টের পর মাহবুবুল হকের সহযোগিরা নানা দুর্নীতির অভিযোগ থাকার পরও রহস্যজনকভাবে এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছেন।

২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ছিলেন। ওই সময়ে মন্ত্রীর প্রভাব কাটিয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কর্মকর্তাদের সুবিধা প্রদান, বদলি, পদোন্নতির বাণিজ্য ও ঘুষ নেয়ার অভিযোগ রয়েছে সাবেক এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।

জানা গেছে, মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক দায়িত্ব পাওয়ার আগে মাহবুবুল হক বিশ্বব্যাংক অর্থায়নের প্রকল্প ‘সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্টের (এসসিএমএফপি) প্রকল্প পরিচালক ছিলেন।

২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ওই প্রকল্পে অন্তত ২ হাজার কোটির কাজ বাস্তবায়ন করা হয়। তার মধ্যে ৪ টি বিভাগের উপকূলীয় ১৬ টি জেলার ৭৫টি উপজেলা ও ৭৫০টি ইউনিয়নে মৎস জরিপ, মজুত নিরূপণ, সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন, মৎস্যসম্পদের অধিকতর কার্যকর পরিবীক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি (এমসিএস) পদ্ধতির বাস্তবায়ন, উপকূলীয় অঞ্চলে মৎস্যবাজার উন্নয়নকরণ, বাগদা চিংড়ির উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধি, দরিদ্র মৎস্যজীবী জনগোষ্ঠীর বিকল্প জীবিকায়নে সহায়তা, সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা।

২০২০ সালে দেশব্যাপি কোভিড-১৯ সংক্রমনের সময় মৎস সেক্টরের আওতায় চাষি, ব্যবসায়ি ও সংশ্লিষ্টদের আর্থিক ক্ষতির বিবেচেনা করে ১০০ কোটি টাকা সহায়তা প্রদান করে সরকার।

‘সাসটেইনেবল কোস্টাল এন্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট’-এর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্য সেক্টরের জন্য একশত কোটি টাকা নগদ সহায়তা প্রদান করে। ওই প্রকল্পের মাধ্যমে ৫ টি উপজেলায় ৭৮ হাজার ৭৪ জনকে সাতটি ক্যাটাগরিতে এ প্রণোদনা দেয়া হয়। সেখানে ঘুষ নেয়ার মাধ্যমে স্বজনপ্রীতি, প্রকৃত সুবিধা ভোগীদের না দিয়ে নামমাত্রে কিছু জায়গায় প্রণোদনার কাজ সেরে প্রকল্পের বেশির ভাগ অর্থ হরিলুট করে মহাপরিচালকসহ কর্মকর্তাদের পকেটে ভরার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।

একাধিক ভুক্তভোগীরা জানান, মৎস্য অধিদপ্তরে প্রণোদনার আর্থিক সহায়তা পাওয়ার তালিকায় না উঠাতে মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের দিতে ঘুষ দিতে হয়েছে। ঘুষের পরিমাণ ছিল প্রণোদনা পাওয়ার ৩০ থেকে ৫০ ভাগের অর্থ। প্রণোদনার কাজটি সম্পূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন মৎস কর্মকর্তাদের আওতায়। কোভিডের-১৯ এর সময় অনেকেই বাধ্য হয়ে তাদেরকে ঘুষ তালিকায় নাম উঠিয়েছেন।

এমএসিএমএফপি প্রকল্পের আওতায় অন্তত দুই শতজন লোককে মেরিন ফিশারিজ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, এই নিয়োগকৃতদের কাছ থেকে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা ঘুষ নেয়া হয়।

এসপিএফ বাগদা চিংড়ি পিএল, পোনা উৎপাদনের চিংড়ি হ্যাচারি পরিচালকদের, মালিকদের হ্যাচারি উন্নয়নে মৎস মহাপরিচালকের আওতায় অন্তত ১৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান বিতরণ করে সরকার।

অভিযোগ রয়েছে, অনুদানের অর্থ নয়ছয় করে প্রকল্পের বেশির ভাগ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন প্রকল্পের কর্মকর্তা, প্রকল্প পরিচালক ও মহাপরিচালক খন্দকার মাহবুবুল হক।

এছাড়া, ‘এসসিএমএফপি’ নামীয় প্রকল্পের পরিচালক থাকাকালীন সময়ে সাবেক মৎস মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত মহাপরিচালকের সঙ্গে যোগসাজশ করে প্রকল্পের জন্য কেনা স্পীডবোর্ড ক্রয় ও বিভিন্ন যন্ত্রাংশের কেনার অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।

পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ এর মোতাবেক প্রকল্পের মোট ব্যয়ের সর্বোচ্চ শতকরা তিন ভাগের অধিক অর্থ ব্যয়ে পরামর্শক ফার্ম নিয়োগের ক্ষেত্রে বিধি নিষেধ করা হয়েছে। সেখানে নিয়ম না মেনে প্রকল্পের ব্যয় শতকরা ৮ ভাগ বাড়িয়ে অর্থাৎ ৩৮০ কোটি টাকার ব্যয়ে পরামর্শক ফার্ম নিয়োগ করা হয়।

এতে অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে সরকারের অন্তত ২৬ কোটি অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠে মাহবুবুল হকের বিরুদ্ধে। একইসঙ্গে পুকুর খননের নামে ভুয়া চালানের মাধ্যমে তহবিল বিতরণ করা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রকল্প এলাকার ক্লাস্টার কৃষকদের জন্য পুকুরখনন কার্যক্রম না করেই এসব অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে।

ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল টেকনোলজি প্রোগ্রামের (এনএটিপি) আওতায় প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন খন্দকার মাহবুবুল হক। অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্পের উপকরণ ক্রয়ের ক্ষেত্রে ভুয়া কাগজ দেখিয়ে বাজারমুল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মুল্যে মালামাল ক্রয় করা হয়।

ভুয়া কাগজপত্র ও অধিক মুল্যে মালামালের তথ্য কোটেশন/দরপত্র কমিটির সভাপতি স্বাক্ষর না নিয়ে ক্ষমতা দেখিয়ে প্রকল্পের বাস্তবায়ন করে কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে।

এছাড়া, ওই এনএটিপি প্রকল্পের জন্য তিশত মোটরসাইকেল ক্রয় করা হয়। অনিয়েমর আশ্রয় নিয়ে জাপানি মোটরসাইকেলের কেনার তথ্য দেখিয়ে কেনা হয় ভারতের হিরো নামের মোটরসাইকেল।

ওই সময়ে অভিযোগের বিষয়টি নিয়ে বিভাগীয় অনুসন্ধান শুরু হলে প্রকল্পের পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে সিরাজগঞ্জ জেলা মৎস অধিদপ্তরে বদলি করা হয়।

চলতি বছরের গত ২৮ ডিসেম্বর সিলেটের টিলাগড়ে ইনস্টিটিউট অব লাইভস্টক সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির উদ্বোধন অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছেন, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়াধীন বিভিন্ন অধিদপ্তরে বিগত সরকারের আমলে হওয়া আর্থিক দুর্নীতি তদন্ত করে সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা হবে। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের বিষয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

অভিযোগের বিষয়ে সাবেক মৎস মহাপরিচালক খন্দকার মাহবুবুল হক জানান, আমি যেহেতু দায়িত্বে ছিলাম, কত অভিযোগ থাকবে আমার বিরুদ্ধে, এসব অভিযোগ সঠিক না।

কক্সবাজারের নিরিবিলি চিংড়ি হ্যাচারির অনুদানের বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যা করেছি মন্ত্রণালয়ের নিদের্শ মোতাবেক করেছি। নিজ থেকে কোনো কিছু করা হয়নি।

মৎস অধিদপ্তরের মহাপরিচালক থাককালীন সময়ে মাঠপর্যায়ে ঘুষণ গ্রহণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিকট থেকে এই বিষয়ে উত্তর নেয়ার পরামর্শ দেন। অনিয়মের অর্থে সম্পদ গড়ার বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে খন্দকার মাহবুবুল হক জানান, ‌‌আমার তেমন কোনো সম্পদ নেই। আপনি চাইলে খোঁজ নিতে পারেন।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা মো. মামুন হাসান আমার দেশকে বলেন, ‘গত দেড় মাস হয়েছে মন্ত্রণালয়ে কাজে যোগদান করেছি। এই বিষয়ে আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হবে।

মন্তব্য করুন