
নিউজগার্ডেন ডেস্ক: হালদা নদীর বিভিন্ন শাখা খালে ‘অপরিকল্পিতভাবে’ দেয়া স্লুইচ গেট কাজে আসছে না। এগুলো তুলে দিলে বাঁচবে হালদা নদী ও সংশ্লিষ্ট শাখা খাল’। ‘চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি দখল হয়েছে কর্ণফুলী নদী। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা সত্ত্বেও দখলদারদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে না’। ‘কর্ণফুলী দখল করে ফিশারিঘাটে নতুন মাছবাজার হয়েছে। নদী দখলমুক্ত করে উচ্ছেদ করতে হবে এ বাজার’। ‘পর্যটন শিল্পের জন্য সবচেয়ে সম্ভাবনাময় নদী শঙ্খ বা সাঙ্গু। কিন্তু পাথর তুলে ধ্বংস করা হচ্ছে এ নদী’।
চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ তিন নদী–হালদা, কর্ণফুলী এবং সাঙ্গু নিয়ে এসব অভিযোগ করেছেন নদীপারের বাসিন্দারা। তাদের সবার চাওয়া ভরাট, দখল ও দূষণ থেকে রক্ষা পাক নদীগুলো। গতকাল দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) আয়েজিত ‘শিল্প দূষণ থেকে নদী রক্ষায় করণীয়’ শীর্ষক গণশুনানিতে অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন নদীপারের বাসিন্দারা।
এতে প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীন। সভাপতি হিসেবে শুনানি পরিচালনা করেন ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দার খান। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরীয়া। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক শফিক হায়দার চৌধুরী, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মাহবুবুল হক, বেলার হেড অব প্রোগ্রাম ফিরোজুল ইসলাম, প্রোগ্রাম কোর্ডিনেটর এ এম এম মামুন। জলাবদ্ধতা নয়, নদীর কান্না : চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীন বলেন, চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিয়ে আমরা খুব উদ্বিগ্ন। এটা (জলাবদ্ধতা) নদী যে মরে যাচ্ছে তার কান্না। সেই কান্নায় আমরা ডুবে যাচ্ছি। যতদিন নদীকে বাঁচাতে না পারব, ততদিন নদীর কান্না থামবে না এবং জলাবদ্ধতাও কমবে না। সরকারের পাশাপাশি আমাদের নিজেদেরও নদী রক্ষায় সচেতন হতে হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের অনেকগুলো নদী প্রায় মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে আছে। এটার জন্য কেবল প্রাকৃতিক কারণ নয়, আমরাও দায়ী। আমাদের প্রতিষ্ঠান আছে, আইন আছে, নিয়ম আছে এবং আইন প্রয়োগ করার জন্য আমরা নিয়োজিত আছি; কিন্ত দুঃখজনক হচ্ছে কিছু কিছু লোক রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে দুর্বৃত্তায়ন সৃষ্টি করে। আমরা সকলে সেই দুর্বৃত্তায়নের শিকার হই। তিনি বলেন, আমাদের যে জনবল তার চেয়ে দুর্বৃত্তদের সংখ্যা বেশি। আমরা অভিযান পরিচালনা করছি। কিন্তু দুর্বৃত্ত যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে সেভাবে আমরা বৃদ্ধি (অভিযান) করতে পারছি না। আমাদের দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে।
‘বিপর্যন্ত কর্ণফুলী, হালদা ও শঙ্খ নদী রক্ষায় করণীয়’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, দেশে ১ হাজার ১৫৬টি নদী। চট্টগ্রামে নদীর সংখ্যা কম হলেও শীর্ষ ১০ নদীর তালিকায় চট্টগ্রামের নদীগুলো স্থান পাবে। তিনি দূষণ, কাপ্তাই বাঁধ, দখল ও জলাবদ্ধতা কর্ণফুলী নদীর প্রধান হুমকি উল্লেখ করে বলেন, চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি দখল হয়েছে কর্ণফুলী নদী। চট্টগ্রাম বন্দরের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য কর্ণফুলী টিকিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু কর্ণফুলী রক্ষায় মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী কোনো পরিকল্পনা নেই বন্দরের। স্বল্পমেয়াদী হিসেবে ড্রেজিং করছে, কিন্তু সেটা সমাধান নয়। কাপ্তাই বাঁধ না থাকলে কর্ণফুলী খরস্রোতা হিসেবেই থাকত।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, কর্ণফুলী নদী দূষণের শিকার। নদীর জলজ প্রাণীদের মধ্যেও পড়েছে দূষণের প্রভাব। কর্ণফুলী নদীতে ৬৬টি মিঠাপানির মাছের প্রজাতির মধ্যে ২০–২৫টি প্রজাতি প্রায় বিলুপ্ত এবং ৫৯টি নোনা পানির মাছের প্রজাতির মধ্যে ১০টি প্রজাতি হারিয়ে গেছে। ডলফিনসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী রয়েছে সংকটাপন্ন অবস্থায়।
মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, হালদা বাংলাদেশের একমাত্র নদী যেটা হেরিটেজের স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশের নদী ব্যববস্থাপনার জন্য মডেল হালদা নদী। তবে এ নদীর জন্য ফাঁসির মঞ্চ হয়ে আছে ভূজপুর রাবার ড্যাম।
অধ্যাপক শফিক হায়দার চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রাম শহরে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই। ফলে আবর্জনা খাল হয়ে কর্ণফুলীতে পড়ছে। কাজেই কর্ণফুলী দূষণের জন্য আমরাই দায়ী। তিনি বলেন, নদী কখনো আর্বজনার স্তূপ হতে পারে না। নদী বর্জ্য গ্রহণের জন্য আসেনি। নদী জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য এসেছে। নদীকে রক্ষা করতে হবে।
আমার ভাই স্ট্রোক করে মারা গেছে : শুনানিতে হালদা নদী, কর্ণফুলী নদী, সাঙ্গু নদী ও মাতামুহুরী নদীপারের নারী-পুরুষ অংশ নেন। এছাড়া বিভিন্ন সরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরাও বক্তব্য রাখেন।
এতে নগরের পাথরঘাটা মনোহরখালীর পান্না দাস বলেন, আমরা বংশপরম্পরায় পাথরঘাটা ইকবাল রোডে চাক্তাই খালের পাশে মনোহরখালী মাছবাজারে ব্যবসা করে আসছিলাম। আমার ভাই একটা বরফকল চালাতেন সেখানে। এই আয় দিয়ে আমাদের সংসার চলত। কিন্তু ২০১৭ সালে পুরোনো বাজারটি বন্ধ করে দিয়ে কর্ণফুলী দখল করে নির্মাণ করা হয় একটি নতুন মাছবাজার। সেখানে আমাদের দোকান বরাদ্দ দেওয়ার কথা; কিন্তু দেওয়া হয়নি। দোকান না পেয়ে আমার ভাই স্ট্রোক করে মারা যান। এখন আমরা চলতে পারি না।
চট্টগ্রামের খাল ও নদী রক্ষা সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলীউর রহমান বলেন, কর্ণফুলী দখল করে ফিশারিঘাটে নতুন মাছবাজার হয়েছে। পুরোনো বাজার উচ্ছেদ করে সেখানকার বাসিন্দাদের রুটি রুজি কেড়ে নেওয়া হয়। নতুন বাজারটি বন্ধ করতে আদালতের আদেশ রয়েছে। এটা উচ্ছেদ করে নদী দখলমুক্ত করতে হবে। ডিম সংগ্রহকারী কামাল উদ্দিন সাওদাগর হালদার বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেন।
হালদা পারের বাসিন্দা মুজিবুল হক বলেন, হালদার সঙ্গে সংযুক্ত বিভিন্ন খালে অপরিকল্পিতভাবে স্লুইচ গেট দেয়া হয়েছে। এগুলো কোনা কাজে আসছে না। স্লুইচ গেটের জন্য শাখা খালও ভরাট হচ্ছে। এগুলো তুলে দিলে নদী এবং এলাকার খালগুলো বাঁচবে। সুমন রায় নামে এক জেলে অভিযোগ করে বলেন, দখল ও দূষণের জন্য কর্ণফুলীতে মাছ পাচ্ছি না।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ্র চন্দ বলেন, পতেঙ্গা থেকে ১৭০ কিলোমিটার দূরেও পলিথিন পাওয়া যাচ্ছে। নদীর তলে তো মাটি নেই, পলিথির আস্তর পড়ে গেছে। তিনি রাউজান মিয়া বাজার থেকে পূর্ব পাশে মৈশকরম উরকিরচরে রাত ১০টার পর হালদা থেকে সবার অগোচরে বালু তুলে নদীকে হুমকিতে ফেলা হচ্ছে বলে জানান।