
নিউজগার্ডেন ডেস্ক: প্রশাসন ও জনসম্মুখ থেকে আড়াল রাখতে নির্মাণাধীন ভবনের সামনে রঙ্গিন টিনের বেশ উঁচু ও বড় বেষ্টনী। রেখেছে বাড়তি নিরাপত্তা। দিনের বেলায় বন্ধ থাকে গেইট। ভেতরে থাকা নির্মাণ শ্রমিককের প্রয়োজনে খোলা হয়। বেশ কয়েক বছর ধরে অত্যন্ত সুকৌশলে চট্টগ্রাম নগরের আসকার দীঘির পাড় এলাকায় পাহাড় কেটে নির্মাণ করা হচ্ছে সতেরতলার বহুতল ভবন।
এদিকে, যাচাই-বাচাই না করে বহুতল ভবনের নকশা অনুমোদন দেয় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। শর্তসাপেক্ষে ভবন নকশার অনুমোদন দিয়ে দায় সেরেছে সিডিএ।
চারবছর আগে পাহাড় কেটে বহুতল ভবন নির্মাণের অভিযোগ উঠলে সেখানে অভিযান পরিচালনা করে জরিমানা আদায় করে পরিবেশ অধিদপ্তর ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। পরবর্তীতে সেই জরিমানা কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়ার সুযোগ নিয়ে নির্বিচারে পাহাড় কেটে বহুতল ভবন নির্মাণ চলমান রেখেছেন ভূমিদস্যূরা। সংশ্লিষ্ট এসব দপ্তরের রহস্যজনক ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পরিবেশবিদরা।
সরেজিমনে গিয়ে দেখা গেছে, ওই জায়গাটি ঘিরে রয়েছে দৃশ্যমান পাহাড়। দিনের আলোতে ওই ভবনের বেষ্টনীর ভেতরে প্রবেশের দরজা বন্ধ থাকে। ভেতরে নিরাপত্তা প্রহরীরা থাকেন। রাত ১১টার পর ভেতরে নির্মাণ সামগ্রীর ঢোকার পাশাপাশি কাটা মাটি পরিবহনের করে আসে ভোর পর্যন্ত। ইতোমধ্যে বহুতল এই ভবনের পিলার ও রিটেইনিং দেয়ালের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। ১৭ তলা বিশিষ্ট নির্মাণাধীন ওই ভবনে তৈরি করা হচ্ছে ‘স্বপ্নীল ফ্যামিলি ওনার্স’ নামীয় ৯২ জনের ফ্ল্যাট।
২০২০ সালের ১ জুন নগরের আসকার দীঘির পাড় এলাকায় ২৮ হাজার বর্গফুট পাহাড় কাটার দায়ে ২ জনকে ২৮ লাখ টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম। পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মেট্রোর উপপরিচালক মিয়া মাহমুদুল হক বলেন, ‘নির্মাণ কাজের জন্য জায়গা বাড়াতে দুজন ব্যক্তি গ্রিনলেজ ব্যাংক পাহাড় কেটে সমান করেছিলেন।’
২০২৩ সালের ১৮ জানুয়ারি নগরের আসকার দিঘীর পাড়ে এই অভিযান পরিচালনা করেন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট চৈতি সর্ববিদ্যা। অভিযানের সময় খবর পেয়ে জড়িতরা পালিয়ে যান। নির্মাণ কাজ বন্ধ করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে বলা হয়।
২০২৪ সালের ১৬ জানুয়ারি নির্মাণে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বরাবরে রাতের আঁধারে পাহাড় কেটে ঝঁকিপূর্ণ বহুতল ভবন নির্মাণের অভিযোগ করেন নগরীর আসকার দিঘীর পাড়ের পাশ্ববর্তী এবিসি মাহবুব হিলস ওনার্র ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন। অভিযোগের স্বাক্ষর করেন ফ্ল্যাট মালিক ডা. মর্তুজা নুরুদ্দিন, রফিকুল ইসলাম ও হাসান মানিক। অভিযোগের অনুলিপি দেয়া হয় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক, পরিবেশ অধিদপ্তর, স্থানীয় কাউন্সিলর, কোতোয়ালী থানা ও বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরের আসকার দীঘির পাড় এলাকায় ওই পাহাড়ের ঢালের সর্বোচ্চ উচ্চতা ১২৭ ফুট। পাহাড় সরকারের রেকর্ডে ভিটে হিসেবে অন্তর্ভুক্ত। কয়েক হাতবদল হয়ে সবশেষ ব্যবসায়ী সজল চৌধুরী, খোকন ধর, হিমেল দাশ, সুভাষ নাথ, রনজিত কুমার দে, রূপক সেনগুপ্ত সহ ৯২ জনই ভবনের জায়গার মালিক। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ১০ কোটি টাকায় কেনা জায়গাটি জামালখান এস এস খালেদ রোডে গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকের পাহাড় নামে পরিচিত। ২০২৩ সালের ১৩ এপ্রিল তিনটি বেজমেন্ট ও ১৭ তলা ভবনের অনুমোদন নেয়া হয়।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) চট্টগ্রাম বিভাগীয় নেট ওয়ার্ক মেম্বার আলীউর রহমান বলেন, ‘পাহাড় কেটে ভবন নির্মাণের বিষয়ে সম্প্রতি ভবনটি মালিকদের বেলার পক্ষে একটি লিগ্যাল নোটিশ প্রেরণ করা হলেও সেই নোটিশের সুত্র ধরে হাইকোর্টে রিট করেন ভবন মালিকরা। ওই রিটের পেক্ষিতে ভবনের কার্যক্রম স্থিতিবস্থায় বজায় রাখতে আদেশ দেন হাইকোর্ট। এই আদেশ অমান্য করে প্রশাসনের সামনে ভুলভাবে উপস্থাপন করে নির্বিচারে পাহাড় কেটে নির্মাণ করছে বহুতল ভবন।’
তিনি বলেন, ‘আরও একশ বছর আগে গ্রিনলেজ ব্যাংক ওই জায়গাটি কিনে আবাসিক এলাকা করেছে। সম্প্রতি একটি শ্রেণীর ভূমিদস্যুরা আবাসনের নামে পাহাড় নিশ্চিহ্ন করছে।’
জানতে চাইলে পরিবেশ অধিপ্তরের চট্টগ্রাম মহানগরের তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা রুবাইয়াত তাহরীম সৌরভ এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘২০২০ সালে পাহাড় কেটে ভবন নির্মাণ বিষয়ে পাহাড়ের বিষয়টি দৃশ্যমান থাকায় জরিমান করেছিলাম। কিন্তু ওই জায়গাটিতে পাহাড় থাকা সত্বেও কিছু কাগজের দিক দিয়ে আইনগত জটিলতাও রয়েছে।’
জানতে চাইলে সিডিএ চেয়ারম্যান মো. নুরুল করিম এই বিষয়ে বলেন, ‘আসকার দিঘী পাড় এলাকায় ওই জায়গাতে ভবনের নকশার অনুমোদন দিয়েছে সিডিএ, সেখানে বলা হয়, পাহাড়ের অংশ অক্ষুন্ন রেখে শর্তাবলি দেয়া হয়। পাহাড় কাটার বিষয়ে কাজ করেন মূলত পরিবেশ অধিদপ্তর। ‘
তিনি আরও বলেন, ‘অভিযোগের প্রক্ষিতে ভবনটির কর্তৃপক্ষকে নোটিশ দিয়েছি। সিডিএর নোটিশ পেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন ভবন মালিকপক্ষ। আমরা আইনগত বিষয়ে কাজ করছি।’
এই বিষয়ে জানতে চাইলে ‘স্বপ্নীল ফ্যামিলি ওনার্স’ কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক হিমেল দাশ বলেন, ‘আমরা সিডিএর শর্ত মেনে ভবন নির্মাণ করছি। পাহাড় কাটছি না। যেভাবে তারা নিদের্শনা দিয়েছে সেভাবে নির্মিত হচ্ছে ভবন। আমাদের তিন বেজমন্টে তিনটি পার্কিং সহ মোট ১৭ তলার ভবন নকশার অনুমতি রয়েছে।’
পাহাড় কাটার দায়ে পরিবেশ অধিদপ্তর ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক জরিমানার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, ‘পরিবেশ অধিপ্তরের যে সময় জরিমানা করেছিল, সেসময় ভবনের নকশার অনুমোদন দেয়নি। পরবর্তীতে নিয়েছিলাম নকশার অনুমোদন। সিটি কর্পোরেশন কোনো জরিমানা করেনি।’