
নিউজগার্ডেন ডেস্ক: চট্টগ্রাম বন্দর পণ্য পরিবহন ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে মালিক ও শ্রমিকদের সম্মিলিত আন্দোলনের কারণে অচল হয়ে পড়েছে। এই বর্ধিত ফি কে বহন করবে, তা এখনো নির্ধারিত হয়নি। চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য পরিবহন প্রবেশের ফি চারগুণ বৃদ্ধি করার প্রতিবাদে এই আন্দোলন। মালিক এবং শ্রমিকরা যৌথভাবে এই প্রতিবাদে অংশ নিয়েছেন।
চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার পরিবহনের ট্রেইলার চালাচ্ছেন না মালিকেরা। ভারী গাড়ি প্রবেশের মাশুল ৫৭ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৩০ টাকা করায় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ট্রেইলার মালিকেরা। সংগঠনগুলোর নেতারাও পরিবহণ মালিক-শ্রমিকদের আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন।
চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন জেটিগেটের সামনে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, প্রাইম মুভার, লরির জট দেখা গেছে। ধর্মঘটের বিষয়টি অবগত না হওয়ায় অনেক চালক তাদের যানবাহন নিয়ে বন্দরের গেইটে আসেন। কিন্তু ধমর্ঘটের সমর্থনে শ্রমিকরা বন্দরের নয়টি জেটিগেটের প্রতিটির সামনে সকাল থেকে অবস্থান নেয়। তারা যানবাহনগুলো বন্দরে প্রবেশে বাধা দেয়। এছাড়া চলমান ধমর্ঘটের সমর্থনে মালিক-শ্রমিকরা সম্মিলিতভাবে বন্দরের নয়টি জেটিগেটের সামনে পর্যায়ক্রমে সমাবেশ করেছেন।
নতুন ট্যারিফ সমস্যার সমাধান এক সপ্তাহের মধ্যে না হলে চট্টগ্রাম বন্দর বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন পোর্ট ইউজার্স ফোরামের সভাপতি আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী।
আজ ১৮ অক্টোবর (শনিবার) দুপুরে নেভি কনভেনশন হলে চট্টগ্রাম বন্দরে বিভিন্ন সেবায় অযৌক্তিক ও অতিরিক্ত ট্যারিফ আরোপের প্রতিবাদে পোর্ট ইউজার্স ফোরাম আয়োজিত প্রতিবাদ সভায় তিনি এ হুঁশিয়ারি দেন। স্বাগত বক্তব্যে বিজিএমইএর পরিচালক এম এ সালাম বলেন, ব্যবসায়ীরা দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। ৮৫ শতাংশ আমদানি রপ্তানি চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে হয়। বন্দরের নতুন ট্যারিফে ব্যবসায়ীরা ইনসিকিউরড ফিল করছেন। আমি বিশ্বাস করি, আমরা সমস্বরে না বললে সমাধান হবে না। চট্টগ্রাম বন্দর সেবাকেন্দ্র, লসে নেই। আড়াই-দিনে হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। তাহলে চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে কেন এত কারসাজি। ট্রেইলার ধর্মঘট শুরু হয়েছে, আমাদের কনটেইনার যাবে না। স্টেক হোল্ডারদের দেখে বন্দরের ট্যারিফ শিডিউল পুননির্ধারণ করার দাবি জানাই।
বিজিএমইএ’র পরিচালক এমডিএম মহিউদ্দিন বলেন, বন্দরে ট্যারিফ নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড ঘটে গেছে। ঘর ভাড়া, দোকান ভাড়ার নীতিমালা আছে। বন্দরের নতুন ট্যারিফে ব্যবসায়ীরা প্রাথমিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, পরে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুরোধ জানাই। আমেরিকার ট্যারিফ নিয়ে সুখে নেই আমরা। এর মধ্যে বন্দরের ট্যারিফ বৃদ্ধি কাম্য নয়।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে জাহাজ থেকে কনটেইনার খালাস স্বাভাবিক আছে। তবে কনটেইনার ও খালাস করা পণ্য বন্দরের বাইরে নিতে পারছেন না আমদানিকারকরা। সীমিত আকারে রফতানি পণ্য প্রবেশ করছে। বর্তমানে বন্দরের ইয়ার্ডে এখন প্রায় ৪৬ হাজারের মতো কনটেইনার জমে আছে।
গত ১৪ অক্টোবর রাত ১২টা থেকে প্রবেশমূল্য বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কার্যকরের পর গত বুধবার (১৫ অক্টোবর) থেকে পণ্য পরিবহণ বন্ধ রেখে কর্মবিরতি চালিয়ে আসছিল চট্টগ্রাম ট্রেইলর মালিক সমিতি। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে বন্দরের পণ্য পরিবহণে যুক্ত বিভিন্ন যানবাহনের মালিক-শ্রমিকদের মোট ১৮টি সংগঠন। তারা পণ্য পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ নামে একটি সম্মিলিত মোর্চা গড়ে তুলেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত সরকার কিংবা বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে কোনো গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত না নেবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের ধর্মঘট চলবে। অর্থাৎ অনির্দিষ্টকালের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকবে।
নগরীর কদমতলীতে আন্তঃজিলা মালামাল পরিবহণ সংস্থার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রাম ট্রেইলর মালিক সমিতির সভাপতি মোর্শেদ হোসেন নিজামী, চট্টগ্রাম প্রাইম মুভার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হোসেন, চট্টগ্রাম ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ইউসুফ মজুমদার মানিক, চট্টগ্রাম জেলা প্রাইম মুভার ও ট্রেলার শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আবুল খায়েরসহ মোট ১৮টি সংগঠনের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দরে সম্প্রতি বিভিন্ন সেবাখাতে ৪১ শতাংশ মাশুল বৃদ্ধি কার্যকরের পর বন্দরে যানবাহন প্রবেশের গেট-ফি পাঁচগুণ বেড়ে গেছে। আগে পণ্য পরিবহণকারী প্রতিটি যানবাহনকে ৫৭ টাকা ৫০ পয়সা গেট-ফি দিতে হতো। এখন বাড়িয়ে ২৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর প্রতিবাদে মালিক-শ্রমিক সংগঠগুলো একমত হয়ে পণ্য খালাস বন্ধ রেখেছে।
চট্টগ্রাম প্রাইম মুভার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘এই যে ৫৭ টাকা থেকে ২৩০ টাকা গেইট-ফি হঠাৎ করে বাড়িয়ে দিল, এই টাকাটা কে দেবে? আগে তো এটা ড্রাইভার দিত। কারণ আমাদের এখানে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য যেখানে নিয়ে যাওয়া হতো, সেজন্য যে খরচ নির্ধারণ করা হতো, সেই খরচের মধ্যে এই টাকাটা যুক্ত ছিল। এখন ২৩০ টাকা করার ফলে মাসে ১৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা খরচ বেড়েছে। কিন্তু এখন ড্রাইভারেরা ঘোষণা দিয়েছেন, তারা কোনোভাবেই বাড়তি গেইট-ফি দেবে না, এই টাকাটা মালিককে দিতে হবে। এটা তো আমাদের পক্ষে বহন করা কঠিন।’
চট্টগ্রাম ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ইউসুফ মজুমদার মানিক বলেন, ‘আমরা পণ্য পরিবহণকারী ১৮টা সংগঠন আছি, আমাদের ফেডারেশন আছে। কারও সঙ্গে একবার কথা বলার প্রয়োজন বোধ করল না, হঠাৎ করে ৫৭ টাকা ৫০ পয়সা থেকে গেইট-ফি হয়ে গেল ২৩০ টাকা। আমাদের পরিবহণের মালিকরা এতে ক্ষুব্ধ, শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ, এমনকি ব্রোকাররাও বলছে এভাবে পণ্য পরিবহণ করা সম্ভব নয়। সবাই আমাদের চাপ দিচ্ছে প্রতিবাদ করার জন্য। আমরা পণ্য পরিবহণ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছি।’
চট্টগ্রাম ট্রেইলর মালিক সমিতির সভাপতি মোর্শেদ হোসেন নিজামী বলেন, ‘আকস্মিক প্রবেশ-ফি বাড়ানোর প্রতিবাদে আমরা গত বুধবার থেকে কর্মবিরতি পালন করে আসছি। এখন আমাদের সঙ্গে সর্বস্তরের মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো একাত্মতা প্রকাশ করে তারাও ধর্মঘট শুরু করেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত বন্দর কর্তৃপক্ষ কিংবা সরকার আমাদের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে সুরাহা করবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের কর্মসূচি চলবে।’
শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা অত্যন্ত কনসার্ন। বন্দর কোনো কোনো ক্ষেত্র ৪৪০ শতাংশ ট্যারিফ, চার্জ বাড়িয়েছে। পোর্ট লিমিট বাড়ানোর সময় ট্যারিফ বাড়ানো হয়েছে। পাইলটিং, পোর্ট ডিউজ দিতে হচ্ছে। কস্ট বেইজড ট্যারিফ হওয়া উচিত। শিপ ওনার চার্জ বাড়িয়ে দেবে। শিল্প বাণিজ্য ক্ষেত্রে অচলাবস্থা তৈরি হবে। আমাদের শেষ ভরসা প্রফেসর ইউনূস। ট্যারিফ বাড়াতে হলে স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে বাড়াতে হবে।
বন্দর ট্রাক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির সোহেল বলেন, আমাদের ১২ হাজার গাড়ি আছে বন্দরে। বন্দরের উন্নতির পেছনে আমাদের কিছু ভূমিকা আছে। ২-৩ হাজার টাকায় ট্রিপ মেরে ৫০০ টাকা আয় হয় না, আমার ওপর ৩০ হাজার টাকা আয়কর। বন্দরের নতুন ট্যারিফ শিডিউলে ৫৭ টাকার গেইট পাস ২৩০ টাকা করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম প্রাইম মুভার ও ফ্লাটবেড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, বন্দর ৫৭ টাকার পাসের ফি ২৩০ টাকা করেছে। বন্দরে চালকদের ওয়াশ রুম, ক্যান্টিন নেই। আমাদের ১৫ হাজার গাড়ি, ১০ হাজার শ্রমিক। বন্দর টার্মিনাল দিচ্ছে না ১৫ বছর বলার পরও। তিন ধরনের ট্যাক্স দিই। একজন মানুষ কতবার ট্যাক্স দেবে। এটা সংস্কার করা দরকার।
বাফা’র পরিচালক অমিয় শঙ্কর বর্মণ বলেন, বন্দর ও অফডক একসঙ্গে ট্যারিফ, চার্জ বাড়িয়েছে তা অসহনীয়। কোনো ক্ষেত্রে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
বিপিজিএমইএ শহীদুল্লাহ চৌধুরী বলেন, লুটপাট শুরু হয়েছে। ২০ ফুটের কনটেইনারে লোড আনলোডে ৬০ ডলার খরচ হচ্ছে। বেসরকারি পর্যায়ে আরও বেশি লুট হচ্ছে।
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাইফুল আলম বলেন, ব্যবসায়ীদের জন্য দুসংবাদ। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। বিদেশে ট্যারিফ কমাতে অর্ন্তর্বতী সরকার সফল হয়েছে, ধন্যবাদ জানাই। বন্দর অর্থনীতির লাইফ লাইন। এটা শেষ করতে নান ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে।









