নিউজগার্ডেন ডেস্ক: বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, যারা শ্রমিকদের দাবি নিয়ে তাদের পক্ষে অবস্থান নেবে সে রাজনীতিবিদ এখন কিন্তু আর নেই। রাজনীতিবিদ যারা এমপি ও মন্ত্রী হচ্ছে তারা লুটপাটের রাজনীতির একটি অংশ। বর্তমান সরকার যে লুটপাট করছে তার অংশ হিসেবে কিন্তু এ লোকগুলো রাজনীতিতে আসছে। এদের সঙ্গে রাজনীতি ও জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই। এদের ভোটের ও জবাবদিহিতার প্রয়োজন নেই। এরা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ নেই। তাদের মাধ্যমে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি সেটা কখনও পূরণ হবে না। যারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ না তারা শ্রমিকদের কাছে কি জবাবদিহি করবে।
তিনি মঙ্গলবার (২ জুলাই) বিকেলে নগরীর জিইসি কনভেনশন সেন্টারে চট্টগ্রাম বিভাগীয় শ্রমিকদলের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কর্মশালার সমাপনী অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন।
এতে সভাপতিত্ব করেন বিভাগীয় শ্রমিকদলের সভাপতি এ এম নাজিম উদ্দীন।
সকাল সাড়ে নয়টা থেকে শুরু হয়ে দিনব্যাপী এই কর্মশালার উদ্বোধন করেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। বিভাগীয় শ্রমিকদলের সভাপতি এ এম নাজিম উদ্দীনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এড. শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, কেন্দ্রীয় শ্রমিকদলের সভাপতি আনোয়ার হোসেন।
দ্বিতীয় পর্বে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কর্মশালা শুরু হয় দুপুর বারটায়। কেন্দ্রীয় শ্রমিকদলের সভাপতি আনোয়ার হোসেনের সভাপতিত্বে প্রধান আলোচক ছিলেন চেয়ারপার্রসনের উপদেষ্টা এড শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস। অনুষ্ঠানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের মাঝে সনদ বিতরণ করা হয়।
বিভাগীয় শ্রমিকদলের সাধারণ সম্পাদক শেখ নুরুল্লাহ বাহারের পরিচালনায় সমাপনী অধিবেশনে প্রধান বক্তার বক্তব্য রাখেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন চেয়ারপার্সনের বিশেষ সহকারী এড শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম, কেন্দ্রীয় শ্রমিকদলের সভাপতি আনোয়ার হোসেন, মহানগর বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর, চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিএনপির নবনির্বাচিত সহ সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ শ্রম সম্পাদক হুমায়ুন কবির খান ও মামুন মোল্লা।
আমীর খসরু বলেন, শ্রমিক, মালিক ও সরকারের সম্পর্ক যে নিম্নপর্যায়ে চলে গেছে তার একমাত্র কারণ হচ্ছে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। জনগণের নির্বাচিত সরকার সংসদে না থাকার কারণে আজ শ্রমিকদের সে বিষয়গুলো প্রাধান্য পাচ্ছে না। অথচ একটি দেশের প্রোডাকশনের যে মূল বিষয় সেখানে শ্রমিক অন্যতম। শ্রমিক ব্যতিত উৎপাদনের বিষয় অসম্পূর্ণ থাকবে। শ্রমিকের কল্যাণ যত কম সাধিত হবে উৎপাদন ব্যবস্থা তত ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
তিনি বলেন, শ্রমিকের অবস্থান বাংলাদেশে আজ কোথায়? শ্রমিকের সঙ্গে সরকার, রাজনীতি ও মালিকের সম্পর্ক সেগুলো বিবেচনায় আনা উচিত। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে অনেক বদল আছে। আইনগত দিক থেকে শ্রমিকদের রেজিষ্ট্রেশন দিতে হবে। এটা একটি প্রক্রিয়া। রেজিষ্ট্রেশনের সমস্যা কোথায় এ প্রশ্নটি তুলতে হবে। আমাদের ফরমাল সেক্টরের চেয়ে ইনফরমাল সেক্টরে শ্রমিকদের সংখ্যা এখন বেশি। এ ইনফরমাল সেক্টরেই রেজিষ্টেশনের সমস্যা। শ্রমিক সংগঠনগুলো বর্তমান প্রেক্ষাপটে আইন অনুযায়ী তাদের কাজ ঠিকভাবে করতে পারছে না। যে সমস্ত শ্রমিকনেতা গার্মেন্টস সেক্টরে দাবি নিয়ে সত্যিকার অর্থে কাজ করেছিল তাদের অনেককে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। তাদের অনেকের বাড়ি-ঘরে হামলা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, তাদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়েছে। অনেকে যারা এখনও সে নেতৃত্বে আছেন তারা প্রকৃতপক্ষে সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গার্মেন্টস শ্রমিকদের যে পাওনা সেটার বিষয়ে কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। বিএনপির পক্ষ থেকে আমরা কিন্তু বলেছিলাম ২৫ হাজার টাকা গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার জন্য। শ্রমিকদের পক্ষ থেকেও এ টাকার দাবি দেওয়া হয়েছিল বলে মনে হয়। কিন্তু তাদের বেতন সাড়ে ১২ হাজার। প্রায়ই অর্ধেক। শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য গার্মেন্টস সেক্টরে সত্যিকার অর্থে এ দাবি আদায় করতে কোনো নেতা পাচ্ছে না। একজন শ্রমিক সাড়ে ১২ হাজার টাকা দিয়ে চলা সত্যিকার অর্থে খুবই কঠিন। কোনো সুযোগ নেই সাড়ে ১২ হাজার টাকা দিয়ে একটি পরিবার চলার। কিন্তু সে কাজটা হচ্ছে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের নেতৃত্ব দেওয়া নিয়ে তাদের সংগঠনে যে সমস্যা প্রত্যেকটি সেক্টরে একই কিন্তু। কম আর বেশি।
তিনি বলেন, উৎপাদন ব্যতিত কোনো উন্নয়ন সম্ভব নয়। সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দুইটি স্লোগান ছিল। একটি হচ্ছে উন্নয়নের রাজনীতি ও আরেকটি হচ্ছে উৎপাদনের রাজনীতি। আমাদের এ অবস্থা থেকে যদি মুক্ত হতে হয় আমরা যে আন্দোলনে নেমেছি সেখানে অন্য সবগুলোর সঙ্গে শ্রমিকের স্বার্থ গভীরভাবে জড়িত। শ্রমিকের স্বার্থ যদি আমাদের উদ্ধার করতে হয় এ আন্দোলনে কিন্তু সফল হতে হবে। বিএনপির ২০৩০ ভিশনে শ্রমিকের স্বার্থগুলো আমরা স্পষ্ট করে সেখানে বলেছি। ৩১ দফা যেটা করা হয়েছে সেটা সবার সঙ্গে বসে করা হয়েছে। সকলের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। শুধু শ্রমিকের দাবি নয়, বাংলাদেশের সকল মানুষের রাজনৈতিক, সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার সুনিশ্চিত করার জন্য ৩১ দফায় সব বলা হয়েছে। এটা বিএনপির একার কোনো দাবি নয়। এটা সমস্ত বিরোধী দল বামপন্থী, ডানপন্থী, মধ্যপন্থী সবাই কিন্তু একমত হয়ে এ ৩১ দফা প্রণয়ন করেছে।
আমীর খসরু বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিদায় করলেই বাংলাদেশের সব সমস্যার সমাধান হবে না। ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিদায় করার পর আমরা যদি সাধারণ মানুষের এ দাবিগুলো পূরণ করতে না পারি, জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে না পারি তাদের প্রত্যাশা পূরণ হবে না। সেটা যদি পূরণ করা না যায় আন্দোলন সংগ্রাম করে লাভ কি। কোনো লাভ নেই। এ আন্দোলনে শ্রমিকদের অংশগ্রহণ গুরুত্বপুর্ণ। এ দেশের মানুষের অধিকার ও গণতন্ত্রের মা’র মুক্তি একইসূত্রে গাঁথা। এটাকে আলাদা করা যাবে না। আমাদের যে আন্দোলন সেটার সূত্রপাত হবে আগামী শনিবারে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রামের জনসভা থেকে। চট্টগ্রাম থেকে আবারও নতুনভাবে আন্দোলনের সূত্রপাত হবে এ জনসভা থেকে।
প্রধান বক্তার বক্তব্যে নজরুল ইসলাম খান বলেন, বর্তমান সরকারের দুঃশাসনে শ্রমিক সমাজ আজ অবহেলিত। শ্রমিকদের দুবেলা খাওয়ার সুযোগ নেই। আজকে শ্রমিকদের কর্মসংস্থান ও বাসস্থান নেই। শ্রমিকদের বিষয়ে সরকারের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। অথচ শ্রমিকদের কারণে বাংলাদেশ ঠিকে আছে। সভ্যতা বিনির্মাণের কারিগর হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণির মানুষেরা। ৯০ স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শ্রমিক সমাজের ভূমিকা আন্দোলনকে সফল করেছিল। বর্তমান ফ্যাসিষ্ট ডামি সরকারের বিরুদ্ধে শ্রমিকদেরকে কঠিন আন্দোলনে শরিক হতে হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে এড শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস বলেন, বর্তমানে শ্রমজীবী মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। সরকার ভোটাধিকার হরণ করে দেশের মালিকানা যেমন কেড়ে নিয়েছে, তেমনি শ্রমিক, কৃষকের পেটে লাথি মেরেছে। দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে শ্রমজীবী মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছে তারা। কৃষক, শ্রমিক, তাঁতি ও জেলেদের মুক্তির জন্য কাজ করছে বিএনপি।
মাহবুবের রহমান শামীম বলেন, এই বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কর্মশালা চট্টগ্রামের বিএনপির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান। এর থেকে আমাদের অনেক কিছু শিখার আছে। কারণ দেশ এখন কঠিন সময় পার করছে। আমরা ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি। বর্তমানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে শ্রমিকরাই সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছে। তাই এর থেকে পরিত্রাণ পেতে শ্রমিকদেরকে সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করতে হবে।
আনোয়ার হোসেন বলেন, বিএনপির আন্দোলন ১৫ বছরের অপশাসনের বিরুদ্ধে। দেশের জনগণ ও জাতীয়তাবাদের পক্ষের শক্তির অংশগ্রহণে এক বিশাল আন্দোলনের সূচনা হয়েছে বাংলাদেশে। এ আন্দোলন অব্যহত আছে স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে।
আবুল হাশেম বক্কর বলেন, বিএনপির আন্দোলন জনগণের ভোট কেড়ে নেওয়া আওয়ামী সন্ত্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে। জনগণ সবসময় বিএনপির পক্ষে রায় দিয়েছে। জনগণ এখনও তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করার অপেক্ষায় আছে। বাংলাদেশের মানুষের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন চলমান আছে।
ব্যারিস্টার মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন, শ্রমিকদল আয়োজিত বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কর্মশালার মাধ্যমে শ্রমিকরা তাদের কার্যক্ষমতা ও কর্মপন্থা নিরূপণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। আজকে শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। জনবিচ্ছিন্ন সরকার লুটপাট আর দমন পীড়ন ছাড়া কোন কাজ করছে না। শ্রমিক ইউনিয়ন গুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার না হলে শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ নেই। তাই সকল দমন পীড়ন উপেক্ষা করে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শ্রমিকদের আরো জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে। তারেক রহমানের নেতৃত্বে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেশবাসী প্রস্তুত রয়েছে।
সভাপতির বক্তব্যে এ এম নাজিম উদ্দীন বলেন, আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার পর থেকেই একটা অত্যাচারী রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠেছে। তারা সিন্ডিকেট করে সব কিছুর দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই পাঁচ ভাগ মানুষের ভোট নিয়ে এই সরকার ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। আন্দোলনের মাধ্যমে অচিরেই বিদায় নিতে হবে।
এতে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক এরশাদ উল্লাহ, ইয়াছিন চৌধুরী লিটন, সাংবাদিক জাহিদুল করিম কচি, কেন্দ্রীয় শ্রমিক দলের সহ সভাপতি রফিকুল ইসলাম, সাংগঠনিক সম্পাদক শ,ম জামাল উদ্দিন, প্রচার সম্পাদক মনজুরুল ইসলাম মঞ্জু, অর্থ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম, যুব সম্পাদক খোরশেদ আলম, বিভাগীয় শ্রমিকদলের সহ সভাপতি ইদ্রিস মিয়া, এম আর মঞ্জুর, শাহেনেওয়াজ চৌধুরী মিনু, দক্ষিণ জেলা শ্রমিক দলের সভাপতি শফিকুল ইসলাম চেয়ারম্যান, উত্তর জেলার সভাপতি মোতালেব চৌধুরী, কক্সবাজার জেলার সভাপতি রফিকুল ইসলাম, রাঙ্গামাটি জেলার সভাপতি মমতাজ মিয়া, বান্দরবান জেলার সভাপতি আব্দুস শুক্কুর, খাগড়াছড়ি জেলার সভাপতি মো. আসলাম কালু, লক্ষ্মীপুর জেলার সভাপতি আবুল হাশেম, নোয়াখালী জেলার সভাপতি দেলোয়ার হোসেন প্রমূখ।